গণপিটুনিতে ৬ ছাত্র নিহত : আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে মর্মান্তিক ঘটনা
স্টাফ রিপোর্টার
ঢাকার পাশেই আমিনবাজারের বড়দেশী এলাকায় রোববার রাতে ডাকাত সন্দেহে ৬ কলেজছাত্রকে গণপিটুনিতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। শবেবরাতের রাত সোয়া একটার দিকে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে। গণপিটুনিতে নিহত ছাত্ররা হলেন—তৌহিদুর রহমান পলাশ (২২), ইব্রাহিম খলিল (২২), কামরুজ্জামান কান্ত (১৬), টিপু সুলতান (২২), মুনিফ (২৩), শামস রহিম শামাম (১৭)। এদের মধ্যে মিরপুর বাঙলা কলেজের তিনজন, তেজগাঁও কলেজের একজন, বিআইবিটির একজন ও ম্যাপললিফের একজন ছাত্র। এরা সবাই শ্যামলী ও দারুসসালাম এলাকার বাসিন্দা।
সাভার পুলিশ জানায়, আমিনবাজার এলাকায় কয়েকদিন ধরেই ডাকাতি হচ্ছিল। শনিবারও ওই এলাকায় ডাকাতি হয়। রোববার রাতে আমিনবাজারের বালুর মাঠে একজনের ১০/১২ হাজার টাকা ছিনতাই হয়। এরপরই অপরিচিত ছাত্রদের বড়দেশী এলাকায় অন্ধকারে ঘোরাফেরা এবং একসঙ্গে বসে শলাপরামর্শ করতে দেখে এলাকাবাসীর সন্দেহ হলে তাদের পাকড়াও করা হয়। একই সঙ্গে মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়েছে বলে ঘোষণা দেয়ার পর চারদিক থেকে গ্রামবাসী বাঁশ, লাঠিসহ ধারালো অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে আসেন। তারা ৬ জনকে গণপিটুনি ও কুপিয়ে হত্যা করেন। এদিকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া আল-আমিন জানায়, তারা ৭ বন্ধু শবেবরাতের নামাজ পড়ে আমিনবাজার এলাকায় ঘুরতে গিয়ে এ বিপদে পড়ে। সে জানায়, শবেবরাতের রাতে আমরা ৭ বন্ধু রিকশা থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে বড়দেশী এলাকায় একটি নিরিবিলি জায়গায় একান্তে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাত্ দেখতে পাই অনেক টর্চের আলো আমাদের দিকে পড়ছে এবং মানুষ ধেয়ে আসছে। তারা এসে আমাদের ঘিরে ফেলে এবং মারতে থাকে। আমরা ডাকাত নই বললেও কোনো কাজে আসেনি।
গণপিটুনিতে মর্মান্তিক ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে দারুসসালাম এলাকার বাসিন্দা ও বাংলা কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজধানীর টেকনিক্যাল এলাকায় প্রায় দুই ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখে। অবরোধ চলাকালে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এলে গাবতলীর সঙ্গে মিরপুর ও শ্যামলীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্থানীয় এমপি আসলামুল হক এলাকায় গিয়ে অবরোধকারীদের বিচারের আশ্বাস দিলে দুইটার পর অবরোধ তুলে নেয়া হয়। সকালে মিরপুর বাঙলা কলেজের সামনেও ছাত্ররা বেশ কিছুক্ষণ সড়ক অবরোধ করে রাখে। এ সময় বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাংচুর হয়।
নিহতদের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, তাদের সন্তানদের অপহরণ করে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের সবার বাসা নগরীর দারুসসালাম ও শ্যামলী এলাকায়। এ ঘটনার খবর পেয়ে নিহতদের পরিবার ও এলাকাবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। নিহতদের বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনের কান্না আর আহাজারিতে এলাকার বাতাস ভারী হয়ে যায়। নিহতদের আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী জানান, যে ৬ ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে এরা ভালো ছেলে। একটি ছেলেও খারাপ নয়। নিহত ইব্রাহিম খলিলের বাবা বলেন, আমার ছেলেকে এলাকার কেউ যদি খারাপ বলে আমি যে কোনো বিচার মাথা পেতে নেব। আমার ছেলেকে কেন অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলো? এদিকে এ ব্যাপারে সাভার থানায় পৃথক দু’টি মামলা হয়েছে। বালি ব্যবসায়ী ও পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করা দু’টি মামলায়ই ডাকাতির অভিযোগ আনা হয়েছে। পুলিশ ঘটনার পরে বড়দেশী গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে। সাভার থানার ওসি মাহবুবুর রহমান বলেন, ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে। গ্রামবাসী ডাকাত মনে করে ছাত্রদের হত্যা করেছে।
এ ঘটনার ব্যাপারে জানতে নিহতদের বাসায় গেলে স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। ইব্রাহিমের মা জানান, শবেবরাতের রাতে ইব্রাহিম খলিল নামাজ পড়ে বাসায় এসে ভাত খাওয়ার পর বাইরে যাওয়ার আগে তার কাছে ২০ টাকা চেয়েছিল। তিনি দেননি যাতে ছেলে পটকা-বাজি কিনতে না পারে। চিত্কার করে কাঁদতে কাঁদতে ইব্রাহিম খলিলের মা বিউটি বেগম বলছিলেন, আমার ছেলেকে আমি আর টাকা দিতে পারব না। দারুসসালামের ফল ব্যবসায়ী তাহের আলী ফকিরের ছেলে ইব্রাহিম খলিল মিরপুর বাঙলা কলেজের বিবিএ’র ২য় বর্ষের ছাত্র ছিল। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে বড়।
রোববার সন্ধ্যার পর ২টি টিউশনি করে বাসায় ফেরে মিরপুর বাঙলা কলেজের মেধাবী ছাত্র তৌহিদুর রহমান পলাশ। ফুরফুরা শরিফ মসজিদে নামাজে যাওয়ার জন্য খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে দেয়। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে বাবা মুজিবুর রহমান পলাশের পাঞ্জাবিতে সুগন্ধী লাগিয়ে দেয়। পলাশ মিরপুর বাঙলা কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। রেলওয়ের সাবেক কর্মচারী মুজিবুর রহমানের পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট পলাশ। রাজধানীর মিরপুরের দারুসসালামের ১৬/এ, তাদের বাসা। নিহত পলাশের মা শাহানুর বেগম বারবার বিলাপ করতে করতে মূর্ছা যাচ্ছেন। এলাকাবাসী জানান, পলাশকে এলাকাবাসী খুবই ভালো ছেলে বলেই জানেন। তারা জানান, পলাশ ডাকাত হতে পারে না। তারা এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন।
‘কান্ত তুই মার কাছে আয়। আমার কান্তকে আমার কোলে এনে দাও। কোন অপরাধে তারা আমার কান্তকে মারল?’ নিহত কামরুজ্জামান কান্তর মা বারবার বিলাপ করছেন এভাবেই। কান্তর বাবা সুরুজ মিয়া বলেন, রোববার পবিত্র শবেবরাতে আমি ও কান্ত একসঙ্গে নামাজ আদায় করেছি। বাসায় এসে একসঙ্গে রাতের খাবার খায় সে। তারপর রাত ১০টার দিকে আমার কাছ থেকে ২০ টাকা নিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি আর কোনোদিন ছেলের সঙ্গে নামাজ পড়তে পারব না— একথা বলেই তিনি বিলাপ করতে থাকেন। তিনি আরও জানান, তার ছেলে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিল। গত শনিবার কান্ত মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছে। আমি গরিব মানুষ। দুই বছর আগে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়েছি। আমার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে ডাক্তার বানাব। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে কান্ত সবার বড়।
নিহত শামস রহিম শামামের বাবা অ্যাডভোকেট আমিনুর রহিম। তিনি সুপ্রিমকোর্টের সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। বাসা শ্যামলী ১ নম্বর রোডে। ২০১০ সালে মাস্টারমাইন্ড স্কুল থেকে ‘ও’ লেভেল পাস করার পর এবার ম্যাপললিফে ‘এ’ লেভেল করছিলেন শামাম। তার বাবা আমিনুর রহিম বলেন, তাকে আগামী বছর লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ানোর জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এখন আমার সব শেষ। তিনি আরও বলেন, এদেশে কোনো আইনের বিচার নেই, এদেশে সবই সম্ভব। বিচারের ভার আমি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলাম। এক ভাই এক বোনের মধ্যে শামাম বড়। তার ছোটবোন সাবাহ মাস্টারমাইন্ডে ক্লাস ফাইভে পড়ছে।
আমিনুর রহিম জানান, রোববার রাত সাড়ে ১২টার দিকে শ্যামলী শিশুপল্লী মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া করে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরবে বলে বের হয় শামাম। রাত সাড়ে ৩টার দিকে মসজিদে নামাজ শেষে ঘরে এসে দেখেন ছেলে ঘরে নেই। তখন তিনি ছেলের মোবাইলে ফোন দিলে সাভার থানার একজন পুলিশ অফিসার ফোন রিসিভ করে জানান, একটি ঝামেলা হয়েছে বলে তাকে সাভার থানায় যেতে বলেন। থানায় গিয়ে তিনি তার ছেলের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ দেখতে পান। শামামের এক চাচা বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে’র) সাবেক মহাসচিব এম এ আজিজ। তিনি জানান, ছেলেটি শবেবরাতের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যায়। ভোরে থানা থেকে ফোন আসে তার মার কাছে। পুলিশ বলে থানায় আসেন খুব খারাপ খবর আছে। সেখানে গিয়ে মা-বাবা তার লাশ দেখতে পান। মানুষের বুঝি জীবনের কোন মূল্যই নেই। পুলিশের আচরণই দেখুন, সকালে তারা ছেলেদের ডাকাত বলেই চালাল। এখন বলছে তদন্ত করবে।
শামামদের বাসার পাশেই সাভার হত্যাকাণ্ডের আরেক শিকার মুনিফদের বাসা। তার বাবা মরহুম ডাক্তার আজাদ। ২ ভাইবোনের মধ্যে বড় মুনিফ মিরপুরের বিইউবিটি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। নিহত টিপু সুলতান (২০) তেজগাঁও কলেজের অনার্স ১ম বর্ষের ছাত্র। বাসা শ্যামলী হাজী মসজিদের পাশে।
এলাকাবাসীর প্রশ্নম্ন—সকালে কোনো কিছু চিন্তা-ভাবনা না করেই পুলিশ কেন ঘটনাটিকে ডাকাতি বলল এবং কাদের স্বার্থে টিভির খবরে লাশের সঙ্গে ছুরি-চাপাতির ছবি দেখাল।
আমাদের সাভার প্রতিনিধি নাজমুল হুদা শাহীন জানান, এ ঘটনায় আহত পণ্য বিক্রেতা আল-আমিন (১৯) বলেছেন, তিনি নিজে, নিহত কান্ত ও পলাশ গতকাল রাতে দারুসসালাম ফুরফুরা শরিফ মসজিদে নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে অন্য চারজন এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেন। তারা সেখানে গল্প করছিলেন। এ সময় এলাকার লোকজন তাদের ধাওয়া করে। তারা নিজেদের ছাত্র পরিচয় দেয়ার পরও গ্রামবাসী ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনি দেয়। আহত আল-আমিনের দাবি, ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলো তাদের নয়, গ্রামবাসীর। আহত আল-আমিনকে পুলিশ গ্রেফতার করে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেছে। গ্রেফতারকৃত আল-আমিন আরও জানায়, সে রাজধানীর মাদার ফুড ওয়্যারের একজন বিক্রয় প্রতিনিধি। নিহত ৬ জন তার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
সাভার থানার ডিউটি অফিসার এএসআই ফরিদ গতকাল রাতে জানান, এ ঘটনায় ডাকাতির অভিযোগে থানায় পৃথক দু’টি মামলা হয়েছে। একটি’র বাদী এসআই আনোয়ার হোসেন। অপর মামলার বাদী স্থানীয় বালি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবদুল মালেক। দু’টি মামলাই তদন্ত করবেন থানার ওসি (তদন্ত) মতিয়ার রহমান।
সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন এ ঘটনায় বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করেছেন। মামলায় অজ্ঞাত ১৫-২০ জন গ্রামবাসীকে আসামি করা হয়েছে। আনোয়ার হোসেন জানান, গ্রামবাসী ওই যুবকদের ট্রলারে করে আসার কথা বললেও পুলিশ কোনো ট্রলার দেখতে পায়নি। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দুটি রামদা ও দুটি চাপাতি উদ্ধার করেছে।
সাভার পুলিশ জানায়, আমিনবাজার এলাকায় কয়েকদিন ধরেই ডাকাতি হচ্ছিল। শনিবারও ওই এলাকায় ডাকাতি হয়। রোববার রাতে আমিনবাজারের বালুর মাঠে একজনের ১০/১২ হাজার টাকা ছিনতাই হয়। এরপরই অপরিচিত ছাত্রদের বড়দেশী এলাকায় অন্ধকারে ঘোরাফেরা এবং একসঙ্গে বসে শলাপরামর্শ করতে দেখে এলাকাবাসীর সন্দেহ হলে তাদের পাকড়াও করা হয়। একই সঙ্গে মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়েছে বলে ঘোষণা দেয়ার পর চারদিক থেকে গ্রামবাসী বাঁশ, লাঠিসহ ধারালো অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে আসেন। তারা ৬ জনকে গণপিটুনি ও কুপিয়ে হত্যা করেন। এদিকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া আল-আমিন জানায়, তারা ৭ বন্ধু শবেবরাতের নামাজ পড়ে আমিনবাজার এলাকায় ঘুরতে গিয়ে এ বিপদে পড়ে। সে জানায়, শবেবরাতের রাতে আমরা ৭ বন্ধু রিকশা থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে বড়দেশী এলাকায় একটি নিরিবিলি জায়গায় একান্তে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাত্ দেখতে পাই অনেক টর্চের আলো আমাদের দিকে পড়ছে এবং মানুষ ধেয়ে আসছে। তারা এসে আমাদের ঘিরে ফেলে এবং মারতে থাকে। আমরা ডাকাত নই বললেও কোনো কাজে আসেনি।
গণপিটুনিতে মর্মান্তিক ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে দারুসসালাম এলাকার বাসিন্দা ও বাংলা কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজধানীর টেকনিক্যাল এলাকায় প্রায় দুই ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখে। অবরোধ চলাকালে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এলে গাবতলীর সঙ্গে মিরপুর ও শ্যামলীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্থানীয় এমপি আসলামুল হক এলাকায় গিয়ে অবরোধকারীদের বিচারের আশ্বাস দিলে দুইটার পর অবরোধ তুলে নেয়া হয়। সকালে মিরপুর বাঙলা কলেজের সামনেও ছাত্ররা বেশ কিছুক্ষণ সড়ক অবরোধ করে রাখে। এ সময় বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাংচুর হয়।
নিহতদের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, তাদের সন্তানদের অপহরণ করে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের সবার বাসা নগরীর দারুসসালাম ও শ্যামলী এলাকায়। এ ঘটনার খবর পেয়ে নিহতদের পরিবার ও এলাকাবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। নিহতদের বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনের কান্না আর আহাজারিতে এলাকার বাতাস ভারী হয়ে যায়। নিহতদের আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী জানান, যে ৬ ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে এরা ভালো ছেলে। একটি ছেলেও খারাপ নয়। নিহত ইব্রাহিম খলিলের বাবা বলেন, আমার ছেলেকে এলাকার কেউ যদি খারাপ বলে আমি যে কোনো বিচার মাথা পেতে নেব। আমার ছেলেকে কেন অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলো? এদিকে এ ব্যাপারে সাভার থানায় পৃথক দু’টি মামলা হয়েছে। বালি ব্যবসায়ী ও পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করা দু’টি মামলায়ই ডাকাতির অভিযোগ আনা হয়েছে। পুলিশ ঘটনার পরে বড়দেশী গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে। সাভার থানার ওসি মাহবুবুর রহমান বলেন, ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে। গ্রামবাসী ডাকাত মনে করে ছাত্রদের হত্যা করেছে।
এ ঘটনার ব্যাপারে জানতে নিহতদের বাসায় গেলে স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। ইব্রাহিমের মা জানান, শবেবরাতের রাতে ইব্রাহিম খলিল নামাজ পড়ে বাসায় এসে ভাত খাওয়ার পর বাইরে যাওয়ার আগে তার কাছে ২০ টাকা চেয়েছিল। তিনি দেননি যাতে ছেলে পটকা-বাজি কিনতে না পারে। চিত্কার করে কাঁদতে কাঁদতে ইব্রাহিম খলিলের মা বিউটি বেগম বলছিলেন, আমার ছেলেকে আমি আর টাকা দিতে পারব না। দারুসসালামের ফল ব্যবসায়ী তাহের আলী ফকিরের ছেলে ইব্রাহিম খলিল মিরপুর বাঙলা কলেজের বিবিএ’র ২য় বর্ষের ছাত্র ছিল। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে বড়।
রোববার সন্ধ্যার পর ২টি টিউশনি করে বাসায় ফেরে মিরপুর বাঙলা কলেজের মেধাবী ছাত্র তৌহিদুর রহমান পলাশ। ফুরফুরা শরিফ মসজিদে নামাজে যাওয়ার জন্য খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে দেয়। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে বাবা মুজিবুর রহমান পলাশের পাঞ্জাবিতে সুগন্ধী লাগিয়ে দেয়। পলাশ মিরপুর বাঙলা কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। রেলওয়ের সাবেক কর্মচারী মুজিবুর রহমানের পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট পলাশ। রাজধানীর মিরপুরের দারুসসালামের ১৬/এ, তাদের বাসা। নিহত পলাশের মা শাহানুর বেগম বারবার বিলাপ করতে করতে মূর্ছা যাচ্ছেন। এলাকাবাসী জানান, পলাশকে এলাকাবাসী খুবই ভালো ছেলে বলেই জানেন। তারা জানান, পলাশ ডাকাত হতে পারে না। তারা এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন।
‘কান্ত তুই মার কাছে আয়। আমার কান্তকে আমার কোলে এনে দাও। কোন অপরাধে তারা আমার কান্তকে মারল?’ নিহত কামরুজ্জামান কান্তর মা বারবার বিলাপ করছেন এভাবেই। কান্তর বাবা সুরুজ মিয়া বলেন, রোববার পবিত্র শবেবরাতে আমি ও কান্ত একসঙ্গে নামাজ আদায় করেছি। বাসায় এসে একসঙ্গে রাতের খাবার খায় সে। তারপর রাত ১০টার দিকে আমার কাছ থেকে ২০ টাকা নিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি আর কোনোদিন ছেলের সঙ্গে নামাজ পড়তে পারব না— একথা বলেই তিনি বিলাপ করতে থাকেন। তিনি আরও জানান, তার ছেলে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিল। গত শনিবার কান্ত মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছে। আমি গরিব মানুষ। দুই বছর আগে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়েছি। আমার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে ডাক্তার বানাব। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে কান্ত সবার বড়।
নিহত শামস রহিম শামামের বাবা অ্যাডভোকেট আমিনুর রহিম। তিনি সুপ্রিমকোর্টের সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। বাসা শ্যামলী ১ নম্বর রোডে। ২০১০ সালে মাস্টারমাইন্ড স্কুল থেকে ‘ও’ লেভেল পাস করার পর এবার ম্যাপললিফে ‘এ’ লেভেল করছিলেন শামাম। তার বাবা আমিনুর রহিম বলেন, তাকে আগামী বছর লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ানোর জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এখন আমার সব শেষ। তিনি আরও বলেন, এদেশে কোনো আইনের বিচার নেই, এদেশে সবই সম্ভব। বিচারের ভার আমি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলাম। এক ভাই এক বোনের মধ্যে শামাম বড়। তার ছোটবোন সাবাহ মাস্টারমাইন্ডে ক্লাস ফাইভে পড়ছে।
আমিনুর রহিম জানান, রোববার রাত সাড়ে ১২টার দিকে শ্যামলী শিশুপল্লী মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া করে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরবে বলে বের হয় শামাম। রাত সাড়ে ৩টার দিকে মসজিদে নামাজ শেষে ঘরে এসে দেখেন ছেলে ঘরে নেই। তখন তিনি ছেলের মোবাইলে ফোন দিলে সাভার থানার একজন পুলিশ অফিসার ফোন রিসিভ করে জানান, একটি ঝামেলা হয়েছে বলে তাকে সাভার থানায় যেতে বলেন। থানায় গিয়ে তিনি তার ছেলের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ দেখতে পান। শামামের এক চাচা বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে’র) সাবেক মহাসচিব এম এ আজিজ। তিনি জানান, ছেলেটি শবেবরাতের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যায়। ভোরে থানা থেকে ফোন আসে তার মার কাছে। পুলিশ বলে থানায় আসেন খুব খারাপ খবর আছে। সেখানে গিয়ে মা-বাবা তার লাশ দেখতে পান। মানুষের বুঝি জীবনের কোন মূল্যই নেই। পুলিশের আচরণই দেখুন, সকালে তারা ছেলেদের ডাকাত বলেই চালাল। এখন বলছে তদন্ত করবে।
শামামদের বাসার পাশেই সাভার হত্যাকাণ্ডের আরেক শিকার মুনিফদের বাসা। তার বাবা মরহুম ডাক্তার আজাদ। ২ ভাইবোনের মধ্যে বড় মুনিফ মিরপুরের বিইউবিটি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। নিহত টিপু সুলতান (২০) তেজগাঁও কলেজের অনার্স ১ম বর্ষের ছাত্র। বাসা শ্যামলী হাজী মসজিদের পাশে।
এলাকাবাসীর প্রশ্নম্ন—সকালে কোনো কিছু চিন্তা-ভাবনা না করেই পুলিশ কেন ঘটনাটিকে ডাকাতি বলল এবং কাদের স্বার্থে টিভির খবরে লাশের সঙ্গে ছুরি-চাপাতির ছবি দেখাল।
আমাদের সাভার প্রতিনিধি নাজমুল হুদা শাহীন জানান, এ ঘটনায় আহত পণ্য বিক্রেতা আল-আমিন (১৯) বলেছেন, তিনি নিজে, নিহত কান্ত ও পলাশ গতকাল রাতে দারুসসালাম ফুরফুরা শরিফ মসজিদে নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে অন্য চারজন এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেন। তারা সেখানে গল্প করছিলেন। এ সময় এলাকার লোকজন তাদের ধাওয়া করে। তারা নিজেদের ছাত্র পরিচয় দেয়ার পরও গ্রামবাসী ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনি দেয়। আহত আল-আমিনের দাবি, ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলো তাদের নয়, গ্রামবাসীর। আহত আল-আমিনকে পুলিশ গ্রেফতার করে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেছে। গ্রেফতারকৃত আল-আমিন আরও জানায়, সে রাজধানীর মাদার ফুড ওয়্যারের একজন বিক্রয় প্রতিনিধি। নিহত ৬ জন তার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
সাভার থানার ডিউটি অফিসার এএসআই ফরিদ গতকাল রাতে জানান, এ ঘটনায় ডাকাতির অভিযোগে থানায় পৃথক দু’টি মামলা হয়েছে। একটি’র বাদী এসআই আনোয়ার হোসেন। অপর মামলার বাদী স্থানীয় বালি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবদুল মালেক। দু’টি মামলাই তদন্ত করবেন থানার ওসি (তদন্ত) মতিয়ার রহমান।
সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন এ ঘটনায় বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করেছেন। মামলায় অজ্ঞাত ১৫-২০ জন গ্রামবাসীকে আসামি করা হয়েছে। আনোয়ার হোসেন জানান, গ্রামবাসী ওই যুবকদের ট্রলারে করে আসার কথা বললেও পুলিশ কোনো ট্রলার দেখতে পায়নি। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দুটি রামদা ও দুটি চাপাতি উদ্ধার করেছে।