সাফল্যের আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেরা স্কুলের গৌরব। রাজধানীর রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা তাই মেতেছিল বাঁধভাঙা উল্লাসে
ছবি: জাহিদুল করিমপাসের হার বেশি, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেশি, আর পরীক্ষার্থীও ছিল বেশি। সব মিলিয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। এমন ভালো খবরে দেশজুড়ে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে।
এ বছর আট বোর্ডে গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ১৯ শতাংশ। গত বছর ছিল ৬৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬২ হাজার ১৩৪ জন। গত বছর পেয়েছিল ৪৫ হাজার ৯৩৪ জন। এ বছর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৫ হাজার ৯৫৫ জন ছাত্র এবং ২৬ হাজার ১৭৯ জন ছাত্রী। আট বোর্ড ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলে এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ৮২ হাজার ৯৬১ জন।
এ বছরই প্রথম বাংলা প্রথমপত্র ও ধর্ম বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু হওয়ায় ফলাফলের ওপর কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা ছিল, কিন্তু তা হয়নি। ঢাকা বোর্ডে ২০০৯ সালে বাংলা দুই পত্রে গড় পাসের হার ছিল ৯৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এ বছর ওই দুটি পত্রে পাসের গড় হার ৯৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অন্যদিকে ধর্ম বিষয়ে ২০০৯ সালে পাসের হার ছিল ৯৯ দশমিক ৩৪। এ বছর এ বিষয়ে পাসের হার ৯৯ দশমিক ৪০।
এবার শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গত বছরের ৭২টি থেকে কমে হয়েছে ৪৯। শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গত বছরের দুই হাজার ৭২৬টি থেকে বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ৯২৭।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এই দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন, অন্যান্য বোর্ডেও সৃজনশীল প্রশ্নের ফলে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। তিনি জানান, আগামী বছর বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের প্রতিটিতে দুটি বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন চালু করা হবে। তিনি বলেন, সৃজনশীল প্রশ্ন চালু হলে মুখস্থনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসবে শিক্ষার্থীরা। এর ফলে নোট-গাইড ও কোচিংয়ের দৌরাত্ম্য কমবে।
বোর্ডভিত্তিক পাসের হারের দিক দিয়ে এ বছর সর্বোচ্চ স্থান রাজশাহী বোর্ডের। পাসের হার ৮৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। গত বছর পাসের হার ছিল সর্বনিম্ন ৫৮ দশমিক ৪১ শতাংশ; আর সর্বোচ্চ হার ছিল সিলেট বোর্ডে ৭৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। এ বছর সর্বনিম্ন পাসের হার দিনাজপুর বোর্ডে ৭১ দশমিক ৭০ শতাংশ।
গতকাল শনিবার একযোগে আট শিক্ষা বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। একই সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত দাখিল ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি ভোকেশনাল পরীক্ষার ফলও প্রকাশ করা হয়।
ফল প্রকাশের পর সারা দেশে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী, তাদের পরিবার ও শিক্ষকেরা উল্লাসে মেতে ওঠে। ফুল ও মিষ্টির দোকানগুলোতে মুহূর্তেই ভিড় জমে যায়। ফল সংগ্রহের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শত শত শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা ছুটে যান। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ওয়েবসাইট ও মুঠোফোনে এসএমএসের মাধ্যমেও ফল জেনে নেয়।
সংবাদ সম্মেলন: ফল প্রকাশ উপলক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গতকাল মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এ সময় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। তিনি নকলমুক্ত পরিবেশে পরীক্ষা গ্রহণ ও পরীক্ষা শেষে মাত্র ৫৯ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তিনি চলমান ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখা এবং পাসের হার আরও বাড়ানোর জন্য জোরদার উদ্যোগ নিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান। মন্ত্রী সব উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের অভিনন্দন জানান।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষাসচিব সৈয়দ আতাউর রহমানসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে সকাল ১০টায় শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এসএসসি পরীক্ষার ফল হস্তান্তর করেন। দুপুর একটায় দেশের সব সংশ্লিষ্ট পরীক্ষাকেন্দ্র, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর ওয়েবসাইট এবং মুঠোফোনের সংক্ষিপ্ত বার্তা (এসএমএস) পদ্ধতিতে একযোগে ফল প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়।
জিপিএর শুরু থেকে: ২০০১ সালে গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর প্রথম বছর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৭৬। ২০০২ সালে বেড়ে হয় ৩২৭। ২০০৩ সালে এক হাজার ৩৮৯ জন। ২০০৪ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত মোট নম্বরের সঙ্গে চতুর্থ বিষয়ের নম্বর যুক্ত হওয়ায় জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। ওই বছর আট হাজার ৫৯৭ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিল। ২০০৫ সালে পেয়েছিল ১৫ হাজার ৬৩১ জন। ২০০৬ সালে পায় ২৪ হাজার ৩৮৪ জন। ২০০৭ পেয়েছিল ২৫ হাজার ৭৩২ জন। ২০০৮ সালে পায় ৪১ হাজার ৯১৭ জন। গত বছর পেয়েছিল ৪৫ হাজার ৯৩৪ জন। এ বছর পেয়েছে ৬২ হাজার ১৩৪ জন।
পাসের হার: সর্বোচ্চ হার রাজশাহী বোর্ডে ৮৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। দিনাজপুর বোর্ডে পাসের হার সর্বনিম্ন ৭১ দশমিক ৭০ শতাংশ। চট্টগ্রাম বোর্ডে পাসের হার ৭২ দশমিক ৩১ শতাংশ। যশোর বোর্ডে পাসের হার ৭৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। কুমিল্লা বোর্ডে পাসের হার ৮১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। বরিশাল বোর্ডে পাসের হার ৭৪ দশমিক ৬৪ জন। সিলেটে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৪২।
ঢাকা বোর্ড: এই বোর্ডে এ বছর মোট পরীক্ষার্থী ছিল দুই লাখ ৭১ হাজার ৫২৩। পাস করেছে দুই লাখ ১১ হাজার ৭৬১ জন। পাসের হার ৭৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। গত বছর এই বোর্ডে পাসের হার ছিল ৬৯ দশমিক ১১ শতাংশ।
এ বছর পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক লাখ আট হাজার ৬৮০ জন ছাত্র এবং এক লাখ তিন হাজার ৮১ জন ছাত্রী। আলাদাভাবে ছাত্রদের পাসের হার ৭৯ দশমিক ২১ শতাংশ এবং ছাত্রীদের ৭৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
পাসের হারের দিক দিয়ে যা-ই হোক, জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক দিয়ে অন্যান্য বছরের মতো এবারও ঢাকা বোর্ডই সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। এ বছর এই বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২১ হাজার ১৪২ জন, যা মোট পরীক্ষার্থীর ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এদের মধ্যে ১১ হাজার ৬৯৭ জন ছাত্র ও নয় হাজার ৪৪৫ জন ছাত্রী। গত বছর এই বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১৯ হাজার ৮৬ জন। এদের মধ্যে ১০ হাজার ৫৫৫ জন ছাত্র ও আট হাজার ৫৩১ জন ছাত্রী।
বিদেশের আট কেন্দ্র: ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দেশের বাইরে এ বছর আটটি কেন্দ্রে এসএসসি পরীক্ষা হয়েছে। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২৮১। পাস করেছে ২৬১ জন। পাসের হার ৯২ দশমিক ৮৮ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬২ জন।
দেশের বাইরে আট কেন্দ্রের মধ্যে দুটি আবুধাবিতে। বাকিগুলো মক্কা, জেদ্দা, রিয়াদ, ত্রিপোলি, দোহা ও বাহরাইনের মানামায়।
গত বছর দেশের বাইরে পরীক্ষা হয়েছিল সাতটি কেন্দ্রে। মক্কায় কোনো কেন্দ্র গত বছর ছিল না। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২৫৪ জন। পাস করেছিল ২৪৩ জন। পাসের হার ছিল ৯৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৭৪ জন।