ভারতকে ট্রানজিট এবং বন্দর সুবিধা দেয়ার ব্যাপারে সম্মতিপত্র প্রদানসহ মোট ১২টি চুক্তি প্রটোকল এবং সমঝোতা স্মারক সই হবে ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে। ভবিষ্যতে ঢাকা-দিল্লি সার্বিক সম্পর্কের রূপরেখা কী হবে সে ব্যাপারে সই হবে একটি ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট। গুরুত্বপূর্ণ এ এগ্রিমেন্টটি সই করবেন দুই প্রধানমন্ত্রী। ধারণা করা হচ্ছে, এ চুক্তিটি হবে ইন্দিরা-মুজিব স্বাক্ষরিত ২৫ বছর মেয়াদি সেই মৈত্রী চুক্তির আদলে। যদিও এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং সস্ত্রীক আগামীকাল ৩০ ঘণ্টার এক সফরে ঢাকা আসছেন। এ সফর নিয়ে একদিকে রয়েছে যেমন আগ্রহ, তেমনি তৈরি হয়েছে নানা শঙ্কা। কারণ, যেসব চুক্তি, প্রটোকল এবং সমঝোতা স্মারক সই হবে তার বিস্তারিত এখন পর্যন্ত কিছুই জানানো হয়নি। তবে গতকাল প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী জানিয়েছেন, ড. মনমোহন সিংয়ের সফরে যেসব চুক্তি সই হবে সেগুলো আজ মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে তোলা হবে।
মনমোহনের সফরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যত্ রূপরেখা বিষয়ে একটি ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট সই হবে। দুই প্রধানমন্ত্রী এটা সই করবেন বলে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। দু’দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কসহ সবক্ষেত্রে সহযোগিতার রূপরেখা কী হবে তার দিকনির্দেশনা থাকবে এ চুক্তিতে। ধারণা করা হচ্ছে অতীতের সেই ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী চুক্তির মতোই আর একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে।
এ চুক্তির আওতায় নিরাপত্তা এবং সামরিক সহযোগিতার বিষয়টি থাকছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যেটা সই হবে তা আপনাদের কাছে দিয়ে দেয়া হবে। তখন পড়ে দেখবেন কী আছে চুক্তিতে।
ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়াসহ চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য একটি সম্মতিপত্র বিনিময় করবে দুই দেশ। এ সম্মতিপত্রের আলোকে আগামীতে প্রয়োজনীয় চুক্তি ও প্রটোকল সই হবে। এসব চুক্তি এবং প্রটোকলের মাধ্যমে ভারতের জন্য ট্রানজিট এবং বন্দর সুবিধা নিশ্চিত হবে।
তিস্তা এবং ফেনী নদীর পানিবণ্টন নিয়ে সই হবে দুটি চুক্তি। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে একটি অন্তর্বর্তী চুক্তি। চুক্তিটি হবে ১৫ বছর মেয়াদি। তিস্তা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ঠিক কী পরিমাণ পানি পাবে বা এক্ষেত্রে কোনো গ্যারান্টি ক্লজ থাকবে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু বলেন, চুক্তি হবে সাম্যের ভিত্তিতে।
ভারতের একজন সংসদ সদস্য বলেছেন, তিস্তার ২৫ ভাগ পানি পাবে বাংলাদেশ—এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ডা. দীপু মনি বলেন, এ তথ্য সঠিক নয়। সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য একটি প্রটোকল সই হবে। এর মধ্যে অপদখলীয় ভূমি এবং ছিটমহল হস্তান্তর, সাড়ে ৬ কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এছাড়া রোহানপুর-সিংবাদ রেল যোগাযোগ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সহযোগিতা, মত্স্য সম্পদ উন্নয়নে সহযোগিতা, বিটিভি এবং দূরদর্শনের মধ্যে সহযোগিতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম চালু, সুন্দরবন রক্ষায় যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ, সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রটোকল এবং সমঝোতা স্মারক সই হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর দফতরে মনমোহন সিংয়ের সফর নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
মনমোহন সিংয়ের এ সফরে বহুল আলোচিত ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ কেনার ব্যাপারে যে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল তা শেষ পর্যন্ত হচ্ছে না। এছাড়া দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য ভারতের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাওয়ার ব্যাপারে কি হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, আমরা ভালো কিছু আশা করছি।
অনুপ চেটিয়াকে ফেরত দেয়া বা ভারতে আটক বাংলাদেশী সন্ত্রাসীদের ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারেও সুস্পষ্ট কিছু বলতে পারেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ঢাকায় মনমোহন সিংয়ের কর্মসূচি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে সস্ত্রীক আগামীকাল বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে ঢাকা এসে পৌঁছবেন। তার সফরসঙ্গী হিসেবে আসার কথা রয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণা, পানিসম্পদমন্ত্রী পিকে বনসল, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পাঁচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং ৬০ জন সাংবাদিকের। বিমানবন্দরে মনমোহন সিংকে স্বাগত জানাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যাবেন সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে। তিনি সেখানে ’৭১-এর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। রোপণ করবেন একটি গাছের চারা। স্বাক্ষর করবেন পরিদর্শন বইয়ে। সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে তিনি আসবেন হোটেল সোনারগাঁওয়ে। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি এখানেই থাকবেন। হোটেল সোনারগাঁওয়ে তিনি নির্ধারিত কিছু ব্যক্তির সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেবেন।
পরে অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে তার হোটেল স্যুটে সৌজন্য সাক্ষাত্ করবেন। বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে তিনি যাবেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখানে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথমে কিছু সময়ের জন্য একান্ত বৈঠক করবেন। এর পরপরই অনুষ্ঠিত হবে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে স্বাক্ষর হবে চুক্তি, প্রটোকল এবং সমঝোতা স্মারক। রাত ৮টায় হোটেল সোনারগাঁওয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নৈশভোজে অংশ নেবেন ড. মনমোহন সিং। ৭ তারিখ সকাল ৯টায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী যাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি সেখানে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে একটি বক্তৃতা দেবেন। এরপর তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। মধ্যাহ্নভোজের আগে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত্ করবেন ড. মনমোহন সিং।
বিকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার হোটেল স্যুটে সৌজন্য সাক্ষাত্ করবেন বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ। সন্ধ্যা ৬টায় তিনি দিল্লি ফিরে যাবেন। গত বছর জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের ২০ মাস পর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এ ফিরতি সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
ভারতের সঙ্গে চুক্তির খসড়া আজ মন্ত্রিসভায় উঠছে
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় যেসব চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে তার খসড়া আজ মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বিডিনিউজকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, বিদ্যুত্ খাতে সহযোগিতা, সীমানা বিরোধ নিরসন এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণের মতো বিষয়গুলোই আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে।
দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে যেসব চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে তা আজকের মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করে গওহর রিজভী বলেন, আমরা মনমোহন সিংয়ের এ সফর থেকে ভালো ফল আশা করছি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে একটি নতুন উচ্চতায় এগিয়ে নিতে দুই প্রধানমন্ত্রী এবারও একটি যৌথ ঘোষণা দেবেন। এ বিষয়ে যৌথ ঘোষণায় বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে।