স্টাফ রিপোর্টার
সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফের হাতে নির্মমভাবে নিহত ফেলানীর পরিবারকে গতকাল পেট্রিয়টস অব বাংলাদেশ এবং দৈনিক আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। এ উপলক্ষে ‘শহীদ ফেলানীর পরিবারের পাশে আমরা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, সীমান্তে ভারত এখন কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে থেকে গুলিবর্ষণ করে বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা করছে। আর ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হলে তারা দেশের ভেতরেই গুলি করে বাংলাদেশীদের হত্যা করবে। দলমত নির্বিশেষে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ট্রানজিট নিয়ে কোনো গোপন চুক্তি মেনে নেয়া হবে না। চুক্তি করতে হলে বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে প্রকাশ্যে চুক্তি করতে হবে।
গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে পেট্রিয়টস অব বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন দৈনিক আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। এতে আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহ্বুবউল্লাহ্, চট্টগ্রাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মোহাম্মদ মাহবুবউল্লাহ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, পেট্রিয়টসের মহাসচিব কবি আবদুল হাই শিকদার প্রমুখ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি অলিউল্লাহ নোমান। এতে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম, কুড়িগ্রামের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুর রহমান রানা, সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল বারী, স্বাধীনতা ফোরাম বাংলাদেশের আহ্বায়ক আবু নাসের মোহাম্মদ রাহমাতুল্লাহ। অনুষ্ঠানে ফেলানীর বাবা নূরুল ইসলামকে পেট্রিয়টস অব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকার চেক ও আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকার চেক তুলে দেয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য পাঠান পেট্রিয়টস অব বাংলাদেশের যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি শামসুল আলম চৌধুরী। এছাড়া অনুষ্ঠানে এফ শাহজাহান ও এ কে আজাদসহ তিনজনের লেখা ফেলানী ফেসবুক ও কাঁটাতার নামে দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে মাহমুদুর রহমান বলেন, সীমান্তে ফেলানীকে হত্যা করে যখন কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়, সেই খবরটি তিনি গাজীপুরে জেলে বন্দি অবস্থায় রেডিওতে জানতে পারেন। পরদিন তার স্ত্রী সাক্ষাত্ করতে এলে তিনি ফেলানীর খবর আমার দেশ-এ গুরুত্ব সহকারে ছাপতে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, তথাকথিত বন্ধুরাষ্ট্রের ‘ট্রিগার হ্যাপি’ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী আমাদের কন্যাকে হত্যা করেছে। তার স্ত্রী দেখা করতে গেলে ওই সংবাদটি সঠিকভাবে আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশ করার তাগিদ দেন। মাহমুদুর রহমান বলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা শুধু ফেলানী নয়, আমাদের এরকম অসংখ্য পুত্র-কন্যাকে প্রতিদিন হত্যা করে চলেছে। আর সেই রাষ্ট্রেরই সেবাদাস সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত, তারা প্রতিদিন আমাদের বন্ধুত্বের গল্প শুনিয়ে বেড়াচ্ছেন। কৃতজ্ঞতার ছবক দিচ্ছে। কারণ ’৭১ সালে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু
সেখানে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ ছিল। তারা চেয়েছে নেহরু ডকট্রিন বাস্তবায়ন অর্থাত্ পাকিস্তানকে দুই ভাগ করতে। আমরা চেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা। তাই কৃতজ্ঞতাটা দু’দিক থেকে হওয়া উচিত ছিল। আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তারা আমাদের এক কোটির মতো মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল। আমাদের মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং দিয়েছে, অস্ত্র দিয়েছে। তাদেরও কৃতজ্ঞ থাকা উচিত আমরা তাদের নেহরু ডকট্রিন বাস্তবায়ন করে দিয়েছি। ওই কারণে (একাত্তরের কৃতজ্ঞতা) তারা আমাদের কন্যা ফেলানীকে হত্যার অধিকার রাখে না। আমাদের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমেরিকায় গিয়ে ফেলানী বাংলাদেশের নাগরিক নয়—এমন কথা বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছিলেন। তাকে আমরা ধিক্কার দিতে পারি। এ ধরনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলতে আমার লজ্জা হচ্ছে। এরা এতটাই শৃঙ্খলে আবদ্ধ যে, এদের আর লজ্জা-শরম বলে কিছু নেই। প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য এরা যা খুশি তা-ই করতে পারে।
মাহমুদুর রহমান বলেন, ফেলানীর প্রতি কৃতজ্ঞতার ঋণ আমাদের অনেক বেশি। ফেলানীর ঘটনার মাধ্যমে আমাদের চেতনা একটু ধাক্কা খেয়েছে। বিবেক ধাক্কা খেয়েছে। আমার মনে হয়, আমাদের চেতনায় এরকম একটি ধাক্কা খাওয়ার দরকার ছিল। তবে এজন্য ফেলানীকে তার জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে। এক বাবাকে কন্যা হারানোর শোক সহ্য করতে হচ্ছে। ফেলানী জাতির উপকার করে গেছে। ফেলানী নিহত হওয়ার আগে কোনো ঘটনা আর কোনো নৃশংসতা এভাবে জাতিকে শানিত করেনি।
মাহমুদুর রহমান বলেন, এই সেবাদাস সরকার এখন ভারতকে ট্রানজিট দিচ্ছে। এখন ভারত কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে থেকে গুলিতে আমাদের নাগরিকদের হত্যা করছে। কাঁটাতারের বাইরে থেকে আমাদের কন্যাকে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখছে। ট্রানজিট দেয়া হলে দেশের ভেতর থেকে গুলি করে হত্যা করবে। আমাদের উচিত দলমত নির্বিশেষে এর প্রতিবাদ করা। প্রয়োজনে শহীদ হলেও এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত।
ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, একটি বেদনাদায়ক ঘটনা নিয়ে আমরা এখানে হাজির হয়েছি। একজন কন্যা, একজন সন্তানকে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ বিএসএফের হাতে নির্মমভাবে নিহত হতে হয়েছে। এ ঘটনা এ জাতির অন্ধ বিবেক জাগ্রত করার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। ছোট্ট ওই মেয়েটির কাছে কৃতজ্ঞতায় আমাদের মাথা অনেক নিচু মনে হচ্ছে। যে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, এই দেশের মানুষ এক ইঞ্চি ভূমিও কারও হাতে তুলে দেবে না বা ভূমির ওপর দাবি ছাড়বে না।
আমরা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। কিন্তু এটা হতে হবে সার্বভৌমত্ব ও সমতার ভিত্তিতে। বাংলাদেশ ভারতকে চাহিদামত জোগান দিয়ে যাবে আর ভারত একটু একটু করে দেশের সম্পদ, নদী, পানি, রাস্তাঘাট— সবকিছু দখল করে নেবে এমনটা হতে পারে না। ভারতকে আমাদের দেশের জনগণের জীবনের ওপর অধিকার দেয়া হয়নি।
বিশিষ্ট এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, গত ৭ জানুয়ারি ফেলানী নিগৃহীত হয়ে প্রাণ দিয়েছে। আগামী মাসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় আমাদের অজ্ঞাতসারে ট্রানজিট বা করিডোর চুক্তি, যা-ই বলি না কেন, সেটা হতে হবে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে দেশের মানুষের মতামত নিয়ে। জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই চুক্তি প্রকাশ্যে করতে হবে। গোপনে অর্থাত্ জনতার অজ্ঞাতসারে কোনো চুক্তি করলে এদেশে সেটা বাস্তবায়ন করতে দেয়া হবে না। ভারতকে আমরা শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই না। ভারতকে সবকিছু উজাড় করে দেয়ার জন্য বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। তিনি ফেলানীর বাবার প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে বলেন, এটি একটি প্রতীকী সাহায্য। তিনি ব্যক্তিগতভাবেও ফেলানীর বাবার পরিবারকে সুখী-স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মাহ্বুবউল্লাহ্ বলেন, বিএসএফের গুলিতে ফেলানী নিহত হওয়ার পর তার লাশ চার ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে ছিল। অত্যন্ত বীভত্স ও দুঃখের এই দৃশ্যটি আমাদের চেতনাকে বহুগুণ শানিত করে। ফেলানীর ঝুলে থাকা ছবি ইন্টারনেটে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছে। সবার কাছ থেকে নিন্দা ও প্রতিবাদ হয়েছে। ফেলানীর বাবাকে আজ যত্সামান্য যে সাহায্য দেয়া হচ্ছে, সেটা বলা যায় আমাদের হৃদয়ের অর্ঘ্য। তবে সবচেয়ে বড় অর্ঘ্য হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব শ্বাপদের হাত থেকে নিরাপদ রাখা, তাহলে নিহতের আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।
ফেলানীর বাবা নূরুল ইসলামকে দেখিয়ে ড. মাহ্বুবউল্লাহ্ বলেন, সাধারণ মানুষ কেমন অর্থনৈতিক অসহায় অবস্থায় রয়েছে, তাকে দেখেই বোঝা যায়। এদের সীমান্তে ফেলানীর বাবার মতো গরিব চাষী, গরিব জেলে, গরিব মানুষ যারা বাস করে, তারা সবাই আতঙ্কের মধ্যে আছে কখন গুলি হয়।
চট্টগ্রাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মোহাম্মদ মাহবুবউল্লাহ বলেন, ফেলানীকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, মনে হয়েছে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যেও ভারতকে ট্রানজিট দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যে দেশ আমাদের কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রেখেছে, তারা আমাদের বুকের ওপর দিয়ে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাবে, এর প্রতিবাদ করা উচিত। দেশের এক ইঞ্চি মাটির প্রতি আঘাত এলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের প্রতিবাদ করা উচিত। অথচ অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে একশ্রেণীর মানুষ দেশকে ভারতের কাছে বিকিয়ে দিচ্ছে।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ শহীদ ফেলানীর বাবা নূরুল ইসলামের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে বলেন, হত্যা করে কাঁটাতারে ফেলানীর লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়নি, ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল গোটা বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে। তিনি বলেন, সীমান্তে প্রতি সপ্তাহে বিএসএফ দু-তিনজন করে বাংলাদেশীকে হত্যা করছে। গত ১০ বছরের এক হিসাবে দেখা গেছে, বিএসএফের হাতে ১ হাজারের বেশি বাংলাদেশী হত্যার শিকার হয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। তাই এখন তারা বলছে, সীমান্তে গুলিবর্ষণ করে মানুষ হত্যা করবে না। তবে বিএসএফ এখন সীমান্তে আদিম নৃশংসতায় বাংলাদেশীদের হত্যা করছে। বিএসএফ এখন পিটিয়ে, ঢিল ছুড়ে, কুপিয়ে ও শ্বাসরোধ করে বাংলাদেশীদের খুন করছে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্প্রসারণবাদী ভারতের এই মানবতাবিরোধী তত্পরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে।
স্বাগত বক্তব্যে কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, গত ৭ জানুয়ারি ফেলানীর নির্মম মৃত্যুর পর তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু আর্থিক সহযোগিতার উদ্যোগ নেয়া হয়। অর্থ সংগ্রহের জন্য একটু দেরি হওয়ায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি ফেলানীদের গ্রামে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ঢাকা থেকে ৮ জানুয়ারি কয়েকজন সাংবাদিক ও পেট্রিয়টস এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম সংগঠনের কয়েজন নেতা কুড়িগ্রামে যান। কিন্তু এর আগেই ৬ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ফেলানীদের বাড়িতে যান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফেলানীর বাবাকে কিছু আর্থিক সাহায্য দেন। এর কিছুক্ষণ পরই ফেলানীর বাবাকে গায়েব করে দেয়া হয়। ঢাকা থেকে যে টিমটি কুড়িগ্রামে যায়, রাতেই তাদের হোটেলে অবরুদ্ধ করে ফেলানীর গ্রামের বাড়ি নাগেশ্বরী ও ফুলবাড়ীতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সকালে হোটেল থেকেই বেরুুতে দেয়া হয়নি পেট্রিয়টসের টিমকে। পরে তারা পুলিশি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বাধার মুখে ঢাকায় ফেরত আসতে বাধ্য হন। যার পরিপ্রেক্ষিতে গতকালের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গতকালের অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছে।
গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে পেট্রিয়টস অব বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন দৈনিক আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। এতে আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহ্বুবউল্লাহ্, চট্টগ্রাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মোহাম্মদ মাহবুবউল্লাহ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, পেট্রিয়টসের মহাসচিব কবি আবদুল হাই শিকদার প্রমুখ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি অলিউল্লাহ নোমান। এতে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম, কুড়িগ্রামের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুর রহমান রানা, সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল বারী, স্বাধীনতা ফোরাম বাংলাদেশের আহ্বায়ক আবু নাসের মোহাম্মদ রাহমাতুল্লাহ। অনুষ্ঠানে ফেলানীর বাবা নূরুল ইসলামকে পেট্রিয়টস অব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকার চেক ও আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকার চেক তুলে দেয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য পাঠান পেট্রিয়টস অব বাংলাদেশের যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি শামসুল আলম চৌধুরী। এছাড়া অনুষ্ঠানে এফ শাহজাহান ও এ কে আজাদসহ তিনজনের লেখা ফেলানী ফেসবুক ও কাঁটাতার নামে দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে মাহমুদুর রহমান বলেন, সীমান্তে ফেলানীকে হত্যা করে যখন কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়, সেই খবরটি তিনি গাজীপুরে জেলে বন্দি অবস্থায় রেডিওতে জানতে পারেন। পরদিন তার স্ত্রী সাক্ষাত্ করতে এলে তিনি ফেলানীর খবর আমার দেশ-এ গুরুত্ব সহকারে ছাপতে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, তথাকথিত বন্ধুরাষ্ট্রের ‘ট্রিগার হ্যাপি’ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী আমাদের কন্যাকে হত্যা করেছে। তার স্ত্রী দেখা করতে গেলে ওই সংবাদটি সঠিকভাবে আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশ করার তাগিদ দেন। মাহমুদুর রহমান বলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা শুধু ফেলানী নয়, আমাদের এরকম অসংখ্য পুত্র-কন্যাকে প্রতিদিন হত্যা করে চলেছে। আর সেই রাষ্ট্রেরই সেবাদাস সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত, তারা প্রতিদিন আমাদের বন্ধুত্বের গল্প শুনিয়ে বেড়াচ্ছেন। কৃতজ্ঞতার ছবক দিচ্ছে। কারণ ’৭১ সালে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু
মাহমুদুর রহমান বলেন, ফেলানীর প্রতি কৃতজ্ঞতার ঋণ আমাদের অনেক বেশি। ফেলানীর ঘটনার মাধ্যমে আমাদের চেতনা একটু ধাক্কা খেয়েছে। বিবেক ধাক্কা খেয়েছে। আমার মনে হয়, আমাদের চেতনায় এরকম একটি ধাক্কা খাওয়ার দরকার ছিল। তবে এজন্য ফেলানীকে তার জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে। এক বাবাকে কন্যা হারানোর শোক সহ্য করতে হচ্ছে। ফেলানী জাতির উপকার করে গেছে। ফেলানী নিহত হওয়ার আগে কোনো ঘটনা আর কোনো নৃশংসতা এভাবে জাতিকে শানিত করেনি।
মাহমুদুর রহমান বলেন, এই সেবাদাস সরকার এখন ভারতকে ট্রানজিট দিচ্ছে। এখন ভারত কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে থেকে গুলিতে আমাদের নাগরিকদের হত্যা করছে। কাঁটাতারের বাইরে থেকে আমাদের কন্যাকে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখছে। ট্রানজিট দেয়া হলে দেশের ভেতর থেকে গুলি করে হত্যা করবে। আমাদের উচিত দলমত নির্বিশেষে এর প্রতিবাদ করা। প্রয়োজনে শহীদ হলেও এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত।
ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, একটি বেদনাদায়ক ঘটনা নিয়ে আমরা এখানে হাজির হয়েছি। একজন কন্যা, একজন সন্তানকে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ বিএসএফের হাতে নির্মমভাবে নিহত হতে হয়েছে। এ ঘটনা এ জাতির অন্ধ বিবেক জাগ্রত করার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। ছোট্ট ওই মেয়েটির কাছে কৃতজ্ঞতায় আমাদের মাথা অনেক নিচু মনে হচ্ছে। যে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, এই দেশের মানুষ এক ইঞ্চি ভূমিও কারও হাতে তুলে দেবে না বা ভূমির ওপর দাবি ছাড়বে না।
আমরা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। কিন্তু এটা হতে হবে সার্বভৌমত্ব ও সমতার ভিত্তিতে। বাংলাদেশ ভারতকে চাহিদামত জোগান দিয়ে যাবে আর ভারত একটু একটু করে দেশের সম্পদ, নদী, পানি, রাস্তাঘাট— সবকিছু দখল করে নেবে এমনটা হতে পারে না। ভারতকে আমাদের দেশের জনগণের জীবনের ওপর অধিকার দেয়া হয়নি।
বিশিষ্ট এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, গত ৭ জানুয়ারি ফেলানী নিগৃহীত হয়ে প্রাণ দিয়েছে। আগামী মাসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় আমাদের অজ্ঞাতসারে ট্রানজিট বা করিডোর চুক্তি, যা-ই বলি না কেন, সেটা হতে হবে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে দেশের মানুষের মতামত নিয়ে। জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই চুক্তি প্রকাশ্যে করতে হবে। গোপনে অর্থাত্ জনতার অজ্ঞাতসারে কোনো চুক্তি করলে এদেশে সেটা বাস্তবায়ন করতে দেয়া হবে না। ভারতকে আমরা শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই না। ভারতকে সবকিছু উজাড় করে দেয়ার জন্য বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। তিনি ফেলানীর বাবার প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে বলেন, এটি একটি প্রতীকী সাহায্য। তিনি ব্যক্তিগতভাবেও ফেলানীর বাবার পরিবারকে সুখী-স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মাহ্বুবউল্লাহ্ বলেন, বিএসএফের গুলিতে ফেলানী নিহত হওয়ার পর তার লাশ চার ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে ছিল। অত্যন্ত বীভত্স ও দুঃখের এই দৃশ্যটি আমাদের চেতনাকে বহুগুণ শানিত করে। ফেলানীর ঝুলে থাকা ছবি ইন্টারনেটে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছে। সবার কাছ থেকে নিন্দা ও প্রতিবাদ হয়েছে। ফেলানীর বাবাকে আজ যত্সামান্য যে সাহায্য দেয়া হচ্ছে, সেটা বলা যায় আমাদের হৃদয়ের অর্ঘ্য। তবে সবচেয়ে বড় অর্ঘ্য হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব শ্বাপদের হাত থেকে নিরাপদ রাখা, তাহলে নিহতের আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।
ফেলানীর বাবা নূরুল ইসলামকে দেখিয়ে ড. মাহ্বুবউল্লাহ্ বলেন, সাধারণ মানুষ কেমন অর্থনৈতিক অসহায় অবস্থায় রয়েছে, তাকে দেখেই বোঝা যায়। এদের সীমান্তে ফেলানীর বাবার মতো গরিব চাষী, গরিব জেলে, গরিব মানুষ যারা বাস করে, তারা সবাই আতঙ্কের মধ্যে আছে কখন গুলি হয়।
চট্টগ্রাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মোহাম্মদ মাহবুবউল্লাহ বলেন, ফেলানীকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, মনে হয়েছে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যেও ভারতকে ট্রানজিট দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যে দেশ আমাদের কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রেখেছে, তারা আমাদের বুকের ওপর দিয়ে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাবে, এর প্রতিবাদ করা উচিত। দেশের এক ইঞ্চি মাটির প্রতি আঘাত এলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের প্রতিবাদ করা উচিত। অথচ অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে একশ্রেণীর মানুষ দেশকে ভারতের কাছে বিকিয়ে দিচ্ছে।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ শহীদ ফেলানীর বাবা নূরুল ইসলামের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে বলেন, হত্যা করে কাঁটাতারে ফেলানীর লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়নি, ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল গোটা বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে। তিনি বলেন, সীমান্তে প্রতি সপ্তাহে বিএসএফ দু-তিনজন করে বাংলাদেশীকে হত্যা করছে। গত ১০ বছরের এক হিসাবে দেখা গেছে, বিএসএফের হাতে ১ হাজারের বেশি বাংলাদেশী হত্যার শিকার হয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। তাই এখন তারা বলছে, সীমান্তে গুলিবর্ষণ করে মানুষ হত্যা করবে না। তবে বিএসএফ এখন সীমান্তে আদিম নৃশংসতায় বাংলাদেশীদের হত্যা করছে। বিএসএফ এখন পিটিয়ে, ঢিল ছুড়ে, কুপিয়ে ও শ্বাসরোধ করে বাংলাদেশীদের খুন করছে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্প্রসারণবাদী ভারতের এই মানবতাবিরোধী তত্পরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে।
স্বাগত বক্তব্যে কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, গত ৭ জানুয়ারি ফেলানীর নির্মম মৃত্যুর পর তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু আর্থিক সহযোগিতার উদ্যোগ নেয়া হয়। অর্থ সংগ্রহের জন্য একটু দেরি হওয়ায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি ফেলানীদের গ্রামে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ঢাকা থেকে ৮ জানুয়ারি কয়েকজন সাংবাদিক ও পেট্রিয়টস এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম সংগঠনের কয়েজন নেতা কুড়িগ্রামে যান। কিন্তু এর আগেই ৬ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ফেলানীদের বাড়িতে যান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফেলানীর বাবাকে কিছু আর্থিক সাহায্য দেন। এর কিছুক্ষণ পরই ফেলানীর বাবাকে গায়েব করে দেয়া হয়। ঢাকা থেকে যে টিমটি কুড়িগ্রামে যায়, রাতেই তাদের হোটেলে অবরুদ্ধ করে ফেলানীর গ্রামের বাড়ি নাগেশ্বরী ও ফুলবাড়ীতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সকালে হোটেল থেকেই বেরুুতে দেয়া হয়নি পেট্রিয়টসের টিমকে। পরে তারা পুলিশি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বাধার মুখে ঢাকায় ফেরত আসতে বাধ্য হন। যার পরিপ্রেক্ষিতে গতকালের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গতকালের অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছে।