র্যাবের জন্য বাংলাদেশে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করুন : অ্যামনেস্টি
স্টাফ রিপোর্টার
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর জন্য বাংলাদেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ রাখতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। পাশাপাশি কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে র্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে চার দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে দাতাগোষ্ঠীসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি।
গতকাল লন্ডনে ‘ক্রাইমস আনসিন-এক্সট্রা জুডিশিয়াল এক্সিকিউশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ১২ পৃষ্ঠার ওই রিপোর্টে র্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার মুরাদ, ফোরকান, মিজানুর, নাসির, আসাদুজ্জামান রুবেল, আসাদুল হক শাহীনসহ বেশকিছু ব্যক্তির কেসস্টাডি তুলে ধরা হয়। এছাড়া র্যাবের নির্যাতনে আহত ঝালকাঠির লিমন হোসেন, সাংবাদিক মাসুম ফকিরসহ নির্যাতনের শিকার কয়েকজনের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। রিপোর্টে উদ্বেগ জানিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশে এমন সপ্তাহ বিরল, যে সপ্তাহে র্যাবের গুলিতে আহত অথবা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে না।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে অ্যামনেস্টির চারটি সুপারিশ হলো—এক. একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে, যা ২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংঘটিত সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন এবং অজ্ঞাত বন্দির অভিযোগের বিষয়ে কার্যকর ও যথাযথ তদন্ত করবে। দুই. তদন্তে পাওয়া তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। তিন. পদমর্যাদা বিবেচনা না করে নিরপেক্ষভাবে দায়ীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। চার. প্রকৃত সত্য প্রকাশ করে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। আর এই চারটি সুপারিশ বাস্তবায়নে সহায়তা দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশকে উত্সাহ প্রদান ও র্যাবকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে আহ্বান জানানো হয়।
রিপোর্টে বলা হয়, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত র্যাবের বিরুদ্ধে ২০০ বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা তারা রক্ষা করেননি। বিস্ময়করভাবে এখন আওয়ামী লীগ নেতারাই উল্টো দাবি করছেন, তাদের আমলে দেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়নি।
রিপোর্টে বলা হয়, র্যাবের পাশাপাশি ২০১০ সালের প্রথম থেকে এ পর্যন্ত পুলিশের হাতেও ৩০ জন নিহত হয়েছে। অথচ পুলিশ এগুলোকে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা বলে চালিয়ে দিয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের যে প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে, তা রক্ষায় সরকারকে অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
রিপোর্টে বলা হয়, র্যাব প্রমাণ করার চেষ্টা করছে দুর্ঘটনাবশত অথবা আত্মরক্ষায় এসব হত্যার ঘটনা ঘটছে। অথচ বাস্তবতা হলো, অনেক লোককেই আটকের পর হত্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে পুলিশের একটি শাখা হওয়ার কারণে পুলিশও র্যাবের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হয় না।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ২০০৪ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত র্যাবের বিরুদ্ধে ৭০০ লোককে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। অতীতে এসব হত্যার ব্যাপারে র্যাব অথবা সরকার গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিটি তদন্ত করেছে। তবে সেসব তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য এখনও প্রকাশ করা হয়নি বা গোপনই থেকে গেছে। কখনও বিচারের আওতায় তাদের (র্যাব) আনা হয়নি। র্যাব বরাবরই এসব বেআইনি হত্যার দায়দায়িত্ব অস্বীকার করেছে এবং সরকারও র্যাবের দাবিকে সমর্থন করেছে।
রিপোর্টে বলা হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হতাহতদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও তাদের বিরুদ্ধে আনা অপরাধের অভিযোগ জনগণ মেনে নেয়নি।
অ্যামনেস্টি সব বিচারবহির্ভূত হত্যার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করাসহ অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে।
অ্যামনেস্টির এ রিপোর্টে জানানো হয়, বাংলাদেশ পুলিশ ও র্যাব নিয়মিত বহির্বিশ্ব থেকে বিপুল পরিমাণ সামরিক ও পুলিশ সরঞ্জাম পায়। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, চীন, চেক প্রজাতন্ত্র, ইতালি, পোল্যান্ড, রাশিয়া, স্লোভাকিয়া, তুরস্ক ও আমেরিকা অন্যতম। এছাড়া ২০১০ সালে উইকিলিকস ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের একটি কূটনীতিক তারবার্তা ফাঁস করে। তা থেকে দেখা যায়, ব্রিটেনের পুলিশ বাংলাদেশের র্যাবকে প্রশিক্ষণ দেয়।
বাংলাদেশকে অস্ত্র সরবরাহ না করতে অ্যামনেস্টি এসব দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছে, যেসব দেশ এসব ঘটনা জানার পরও অস্ত্র সরবরাহ করবে, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ যে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার দায় তাদের কাঁধেও বর্তাবে।
অ্যামনেস্টি বলেছে, জনগণের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ২০০৪ সালের মার্চ মাসে র্যাব গঠন করা হয়। বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তত্কালীন সরকার এ উদ্যোগ নেয়।
অ্যামনেস্টি আরও বলেছে, র্যাব গঠনের কয়েক মাস পরেই বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য তারা সমালোচনার মুখে পড়ে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে র্যাব ‘ডেথ ইন ক্রসফায়ার’ হিসেবে চালানোর চেষ্টা করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সন্দেহজনকভাবে কাউকে আটকের পরই এসব হত্যা সংঘটিত হয়। এসব ঘটনার যথাযথ সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও র্যাব দাবি করে, তারা ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি র্যাবের ক্ষমতা সীমিত করার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে রিপোর্টে দাবি করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
অ্যামনেস্টির এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের দাবিকে গ্রহণযোগ্য নয় বলে র্যাবের পক্ষ থেকে মন্তব্য করা হয়েছে। র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের প্রধান কমান্ডার সোহায়েল বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ রিপোর্টের ব্যাপারে অ্যামনেস্টি তাদের কোনো বক্তব্য গ্রহণ করেনি। র্যাব আইনের বাইরে কিছু করছে না এবং আইনগতভাবেই অস্ত্র পাচ্ছে ও ব্যবহার করছে।
অ্যামনেস্টির বাংলাদেশ বিষয়ক গবেষক আব্বাস ফয়েজের সঙ্গে গতরাতে আমার দেশ থেকে লন্ডনে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা অনুসন্ধানের মাধ্যমে সত্য ঘটনা উদঘাটন করে রিপোর্টে তা সন্নিবেশিত করেছি। বস্তুনিষ্ঠতার ব্যাপারে আমরা খুবই সজাগ। র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার যারা হয়েছে, সেসব পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা, মানবাধিকার সংগঠন এবং মিডিয়া রিপোর্টও আমাদের প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছে। তাদের বক্তব্য অনুসন্ধানে র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত উঠে এসেছে।
র্যাবের জন্য বাংলাদেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করার সুপারিশ প্রসঙ্গে আব্বাস ফয়েজ বলেন, এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে, কোনো অস্ত্র উত্পাদনকারী দেশ অন্য দেশের কাছে অস্ত্র বিক্রির আগে তাকে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে অস্ত্র আইনসঙ্গতভাবে ব্যবহৃত হবে; আইনবহির্ভূতভাবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে ব্যবহৃত হবে না। যেহেতু র্যাব দীর্ঘদিন থেকে আইনবহির্ভূত কাজে জড়িত, তাই তাদের জন্য বাংলাদেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে প্রকাশিত রিপোর্টে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তা আব্বাস ফয়েজ বলেন, র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ—র্যাব সদস্যদের দিয়ে কিংবা তাদের অন্তর্ভুক্ত করে তদন্ত করানো মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করেই তদন্ত ও রিপোর্ট প্রকাশ করেছি। এখন র্যাব ও সরকারের দায়িত্ব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত র্যাব সদস্যদের বিষয়ে তারা যে তদন্ত করছে, সেগুলো জনগণের সামনে প্রকাশ ও গ্রহণযোগ্য করা। তিনি বলেন, আমরা চাই সরকার এমন ব্যক্তিদের দিয়ে এসব ঘটনার তদন্ত করুক যারা স্বাধীনভাবে কাজ করার যোগ্য, নিরপেক্ষ, দক্ষ এবং সমাজে যাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এসব তদন্ত রিপোর্ট অবশ্যই জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিজস্ব উদ্যোগে তাদের তদন্ত কাজও চালাতে পারে। সে ম্যান্ডেট তাদের আছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তা বলেন, মাত্র এক সপ্তাহ আগেও র্যাবের গুলির ঘটনা সম্পর্কে সরকার বলেছে, তারা ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের কারণে নিহত বা আহত হয়েছে। তার মানে সরকার একে দুর্ঘটনা হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সন্দেহবশত বেআইনিভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছে।
আব্বাস ফয়েজ বলেন, এটা আশ্চর্যের বিষয় যে, র্যাবের এসব হত্যার কোনো বিচার হয়নি এবং যথার্থতাও প্রমাণ করা হয়নি। তাছাড়া র্যাবের সদস্য যদি প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা হন তাহলে ন্যায়বিচার হতে পারে না, তদন্তও নিরপেক্ষ হতে পারে না। র্যাব কর্তৃক হত্যার সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট করা বন্ধ করতেও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
বন্দিরা অ্যামনেস্টিকে তাদের নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করেছেন বলে রিপোর্টে জানানো হয়। বন্দিরা দাবি করেছেন, কাস্টডিতে তাদের নিয়মিত নির্যাতন করা হতো। খাবার ও ঘুমানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত করাসহ নিয়মিত পেটানো এবং বৈদ্যুতিক শক দেয়া হতো।
আব্বাস ফয়েজ বলেন, র্যাবের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশের অতীত ও বর্তমান সরকার র্যাবের দাবিকে সমর্থন এবং তাদের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা দিয়েছে। আমরা দেখেছি, বর্তমান সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটিয়েছে।
গতকাল লন্ডনে ‘ক্রাইমস আনসিন-এক্সট্রা জুডিশিয়াল এক্সিকিউশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ১২ পৃষ্ঠার ওই রিপোর্টে র্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার মুরাদ, ফোরকান, মিজানুর, নাসির, আসাদুজ্জামান রুবেল, আসাদুল হক শাহীনসহ বেশকিছু ব্যক্তির কেসস্টাডি তুলে ধরা হয়। এছাড়া র্যাবের নির্যাতনে আহত ঝালকাঠির লিমন হোসেন, সাংবাদিক মাসুম ফকিরসহ নির্যাতনের শিকার কয়েকজনের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। রিপোর্টে উদ্বেগ জানিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশে এমন সপ্তাহ বিরল, যে সপ্তাহে র্যাবের গুলিতে আহত অথবা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে না।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে অ্যামনেস্টির চারটি সুপারিশ হলো—এক. একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে, যা ২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংঘটিত সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন এবং অজ্ঞাত বন্দির অভিযোগের বিষয়ে কার্যকর ও যথাযথ তদন্ত করবে। দুই. তদন্তে পাওয়া তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। তিন. পদমর্যাদা বিবেচনা না করে নিরপেক্ষভাবে দায়ীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। চার. প্রকৃত সত্য প্রকাশ করে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। আর এই চারটি সুপারিশ বাস্তবায়নে সহায়তা দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশকে উত্সাহ প্রদান ও র্যাবকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে আহ্বান জানানো হয়।
রিপোর্টে বলা হয়, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত র্যাবের বিরুদ্ধে ২০০ বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা তারা রক্ষা করেননি। বিস্ময়করভাবে এখন আওয়ামী লীগ নেতারাই উল্টো দাবি করছেন, তাদের আমলে দেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়নি।
রিপোর্টে বলা হয়, র্যাবের পাশাপাশি ২০১০ সালের প্রথম থেকে এ পর্যন্ত পুলিশের হাতেও ৩০ জন নিহত হয়েছে। অথচ পুলিশ এগুলোকে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা বলে চালিয়ে দিয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের যে প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে, তা রক্ষায় সরকারকে অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
রিপোর্টে বলা হয়, র্যাব প্রমাণ করার চেষ্টা করছে দুর্ঘটনাবশত অথবা আত্মরক্ষায় এসব হত্যার ঘটনা ঘটছে। অথচ বাস্তবতা হলো, অনেক লোককেই আটকের পর হত্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে পুলিশের একটি শাখা হওয়ার কারণে পুলিশও র্যাবের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হয় না।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ২০০৪ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত র্যাবের বিরুদ্ধে ৭০০ লোককে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। অতীতে এসব হত্যার ব্যাপারে র্যাব অথবা সরকার গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিটি তদন্ত করেছে। তবে সেসব তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য এখনও প্রকাশ করা হয়নি বা গোপনই থেকে গেছে। কখনও বিচারের আওতায় তাদের (র্যাব) আনা হয়নি। র্যাব বরাবরই এসব বেআইনি হত্যার দায়দায়িত্ব অস্বীকার করেছে এবং সরকারও র্যাবের দাবিকে সমর্থন করেছে।
রিপোর্টে বলা হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হতাহতদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও তাদের বিরুদ্ধে আনা অপরাধের অভিযোগ জনগণ মেনে নেয়নি।
অ্যামনেস্টি সব বিচারবহির্ভূত হত্যার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করাসহ অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে।
অ্যামনেস্টির এ রিপোর্টে জানানো হয়, বাংলাদেশ পুলিশ ও র্যাব নিয়মিত বহির্বিশ্ব থেকে বিপুল পরিমাণ সামরিক ও পুলিশ সরঞ্জাম পায়। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, চীন, চেক প্রজাতন্ত্র, ইতালি, পোল্যান্ড, রাশিয়া, স্লোভাকিয়া, তুরস্ক ও আমেরিকা অন্যতম। এছাড়া ২০১০ সালে উইকিলিকস ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের একটি কূটনীতিক তারবার্তা ফাঁস করে। তা থেকে দেখা যায়, ব্রিটেনের পুলিশ বাংলাদেশের র্যাবকে প্রশিক্ষণ দেয়।
বাংলাদেশকে অস্ত্র সরবরাহ না করতে অ্যামনেস্টি এসব দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছে, যেসব দেশ এসব ঘটনা জানার পরও অস্ত্র সরবরাহ করবে, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ যে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার দায় তাদের কাঁধেও বর্তাবে।
অ্যামনেস্টি বলেছে, জনগণের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ২০০৪ সালের মার্চ মাসে র্যাব গঠন করা হয়। বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তত্কালীন সরকার এ উদ্যোগ নেয়।
অ্যামনেস্টি আরও বলেছে, র্যাব গঠনের কয়েক মাস পরেই বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য তারা সমালোচনার মুখে পড়ে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে র্যাব ‘ডেথ ইন ক্রসফায়ার’ হিসেবে চালানোর চেষ্টা করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সন্দেহজনকভাবে কাউকে আটকের পরই এসব হত্যা সংঘটিত হয়। এসব ঘটনার যথাযথ সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও র্যাব দাবি করে, তারা ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি র্যাবের ক্ষমতা সীমিত করার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে রিপোর্টে দাবি করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
অ্যামনেস্টির এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের দাবিকে গ্রহণযোগ্য নয় বলে র্যাবের পক্ষ থেকে মন্তব্য করা হয়েছে। র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের প্রধান কমান্ডার সোহায়েল বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ রিপোর্টের ব্যাপারে অ্যামনেস্টি তাদের কোনো বক্তব্য গ্রহণ করেনি। র্যাব আইনের বাইরে কিছু করছে না এবং আইনগতভাবেই অস্ত্র পাচ্ছে ও ব্যবহার করছে।
অ্যামনেস্টির বাংলাদেশ বিষয়ক গবেষক আব্বাস ফয়েজের সঙ্গে গতরাতে আমার দেশ থেকে লন্ডনে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা অনুসন্ধানের মাধ্যমে সত্য ঘটনা উদঘাটন করে রিপোর্টে তা সন্নিবেশিত করেছি। বস্তুনিষ্ঠতার ব্যাপারে আমরা খুবই সজাগ। র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার যারা হয়েছে, সেসব পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা, মানবাধিকার সংগঠন এবং মিডিয়া রিপোর্টও আমাদের প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছে। তাদের বক্তব্য অনুসন্ধানে র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত উঠে এসেছে।
র্যাবের জন্য বাংলাদেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করার সুপারিশ প্রসঙ্গে আব্বাস ফয়েজ বলেন, এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে, কোনো অস্ত্র উত্পাদনকারী দেশ অন্য দেশের কাছে অস্ত্র বিক্রির আগে তাকে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে অস্ত্র আইনসঙ্গতভাবে ব্যবহৃত হবে; আইনবহির্ভূতভাবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে ব্যবহৃত হবে না। যেহেতু র্যাব দীর্ঘদিন থেকে আইনবহির্ভূত কাজে জড়িত, তাই তাদের জন্য বাংলাদেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে প্রকাশিত রিপোর্টে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তা আব্বাস ফয়েজ বলেন, র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ—র্যাব সদস্যদের দিয়ে কিংবা তাদের অন্তর্ভুক্ত করে তদন্ত করানো মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করেই তদন্ত ও রিপোর্ট প্রকাশ করেছি। এখন র্যাব ও সরকারের দায়িত্ব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত র্যাব সদস্যদের বিষয়ে তারা যে তদন্ত করছে, সেগুলো জনগণের সামনে প্রকাশ ও গ্রহণযোগ্য করা। তিনি বলেন, আমরা চাই সরকার এমন ব্যক্তিদের দিয়ে এসব ঘটনার তদন্ত করুক যারা স্বাধীনভাবে কাজ করার যোগ্য, নিরপেক্ষ, দক্ষ এবং সমাজে যাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এসব তদন্ত রিপোর্ট অবশ্যই জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিজস্ব উদ্যোগে তাদের তদন্ত কাজও চালাতে পারে। সে ম্যান্ডেট তাদের আছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তা বলেন, মাত্র এক সপ্তাহ আগেও র্যাবের গুলির ঘটনা সম্পর্কে সরকার বলেছে, তারা ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের কারণে নিহত বা আহত হয়েছে। তার মানে সরকার একে দুর্ঘটনা হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সন্দেহবশত বেআইনিভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছে।
আব্বাস ফয়েজ বলেন, এটা আশ্চর্যের বিষয় যে, র্যাবের এসব হত্যার কোনো বিচার হয়নি এবং যথার্থতাও প্রমাণ করা হয়নি। তাছাড়া র্যাবের সদস্য যদি প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা হন তাহলে ন্যায়বিচার হতে পারে না, তদন্তও নিরপেক্ষ হতে পারে না। র্যাব কর্তৃক হত্যার সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট করা বন্ধ করতেও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
বন্দিরা অ্যামনেস্টিকে তাদের নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করেছেন বলে রিপোর্টে জানানো হয়। বন্দিরা দাবি করেছেন, কাস্টডিতে তাদের নিয়মিত নির্যাতন করা হতো। খাবার ও ঘুমানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত করাসহ নিয়মিত পেটানো এবং বৈদ্যুতিক শক দেয়া হতো।
আব্বাস ফয়েজ বলেন, র্যাবের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশের অতীত ও বর্তমান সরকার র্যাবের দাবিকে সমর্থন এবং তাদের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা দিয়েছে। আমরা দেখেছি, বর্তমান সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটিয়েছে।