সম্পাদকরা মনে করেন গণমাধ্যমের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ : একরামুল হককে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানি : বরিশালে মানববন্ধনে হামলা
স্টাফ রিপোর্টার
অনলাইন দৈনিক শীর্ষ নিউজ ডটকম ও সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ সম্পাদক একরামুল হককে নিরাপত্তার অজুহাতে রমনা থানায় রাখা হয়েছে। সেখানে তার সঙ্গে কাউকে সাক্ষাত্ করতে দেয়া হচ্ছে না। কলাবাগান থানাপুলিশ তাকে দু’দিনের রিমান্ডে আনলেও রহস্যজনকভাবে ওই থানায় নেয়া হয়নি। আদালত থেকে সরাসরি পুলিশ তাকে নিয়ে যায় রমনা থানায়। হাজতখানায় সাধারণ হাজতিদের সঙ্গেই তাকে রাখা হয়েছে। এদিকে একরামুল হককে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়ার ঘটনা গণমাধ্যমের ওপর সরকারের দমন-পীড়নমূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন সংবাদপত্রের সম্পাদকরা। তারা এ ঘটনাকে সংবাদপত্রের ওপর সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন। ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে একরামুল হকের মুক্তির দাবি জানান তারা। শীর্ষ নিউজ সম্পাদককে গ্রেফতারের প্রতিবাদে বরিশালে সাংবাদিকদের মানববন্ধন কর্মসূচি পণ্ড হয়েছে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায়। হামলায় আহত হন ৫-৬ সংবাদকর্মী। এছাড়াও চট্টগ্রাম, পাবনাসহ বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধনসহ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
সাজানো মিথ্যা মামলায় একরামুল হককে পুলিশ রোববার ভোর রাতে মগবাজারের বাসা থেকে গ্রেফতার করে। মামলার
বাদীর ঠিকানারও অস্তিত্ব নেই। তার বিরুদ্ধে যে বানোয়াট চাঁদাবাজি মামলা দেয়া হয়েছে তা কতখানি সত্য এ বিষয়টিও তদন্ত করেনি পুলিশ। মিথ্যা মামলা দেয়ার অভিযোগে বাদীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো একরামুল হককে জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নেয়া হয়। গতকাল রিমান্ডের প্রথম দিন অতিবাহিত হয়েছে। ঘনিষ্ঠজনদের মতে, কলাবাগান থানার মামলায় একরামুলকে রমনা থানায় রাখা রহস্যজনক। রমনা থানা মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয় সংলগ্ন। জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে গোয়েন্দা পুলিশের মুখোমুখি করা হতে পারে বলে স্বজনরা উদ্বিগ্ন। ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, মিথ্যা মামলায় তাকে রিমান্ডে নিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
একরামুল হকের এক আত্মীয় জানান, রোববার বিকালে একরামুলকে রমনা থানায় নেয়ার পর থেকে পুলিশ ব্যাপক কড়াকড়ি করে। থানার সামনে থেকে সন্দেহজনক লোকজনক সরিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। তিনি হাজতখানায় কী অবস্থায় রয়েছেন তা আমরা জানতে পারিনি। তবে যতটুকু জেনেছি ওই রাতে দু’জন হাজতির সঙ্গে একরামুলকে রাখা হয়েছে। তাকে বাইরে থেকে খাবার সরবরাহ করতে দেয়া হয়নি। তবে অনেক অনুরোধের পর গতকাল ভোরে একরামুলের স্ত্রী মাহবুবা হক ও মেয়ে সুমাইয়াকে এক মিনিটের জন্য সময় দেয় পুলিশ। মাহবুবা হক স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করলেও কথা বলতে পারেননি। পুলিশ নির্দিষ্ট সময় পর মেয়েকে থানা থেকে বের করে দেয়।
মাহবুবা হক বলেন, তার স্বামীকে অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। সরকারের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের খবর প্রকাশ করায় একরামুল হক একটি মহলের টার্গেটে পরিণত হন। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের আমলে গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার দুর্নীতি, যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতি, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি, প্রধানমন্ত্রীর এপিএসের বিভিন্ন অপকর্ম এবং পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রীর দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করায় শীর্ষ নিউজ ও শীর্ষ কাগজ সরকারের রোষানলে পড়ে। এর আগেও তার ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মাহবুবা হক।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কলাবাগান থানার সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) আতিকুর রহমান জানান, সাংবাদিক একরামুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার কাছ থেকে কী তথ্য পাওয়া গেছে জানতে চাইলে এসআই বলেন, কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, যা এখন না বললেই ভালো। তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ওনার ব্যাপারে আর কিছু আমাকে জিজ্ঞাসা না করলেই ভালো। পুলিশের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, ‘একরামুলের কাছ থেকে কী তথ্য পাওয়া যেতে পারে তা আপনিও বুঝেন আমিও জানি। তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য না করে বলেন, এ ধরনের গ্রেফতার ও রিমান্ডে পুলিশ বিব্রত হয়’। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে অনেক সময় পুলিশ অনিয়ম করতে বাধ্য হয়। ওনাকে গ্রেফতার করে থানা হাজতে রেখে পুলিশকে অতিরিক্ত ঝামেলায় ফেলা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, রমনা থানা হেফাজতে গতকাল পর্যন্ত উনি ভালো ছিলেন।’
প্রসঙ্গত, গিয়াসউদ্দিন তালুকদার নামের এক ব্যবসায়ী একরামুল হকের বিরুদ্ধে ঢাকা সিএমএম আদালতে দায়ের করা একটি চাঁদাবাজির মামলায় পুলিশের একটি দল বড় মগবাজারের বাসা থেকে একরামুল হককে গ্রেফতার করে। তবে আদালত মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে তদন্ত করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিলেও তাকে তড়িঘড়ি গ্রেফতার করে পুলিশ।
অনুসন্ধান করে মামলার বাদী গিয়াসউদ্দিন তালুকদারের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বলাকা ইন্টারন্যাশনালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাযনি। মামলার এজাহারে বলাকার ঢাকা কার্যালয় হিসেবে যে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে সরেজমিন গিয়ে ওই নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরও কোনো হদিস মেলেনি। অন্যদিকে চট্টগ্রামে খোঁজ নিয়েও জানা গেছে, বলাকা ইন্টারন্যাশনালের প্রধান কার্যালয় হিসেবে চট্টগ্রাম ফিরিঙ্গিবাজারের কাজী নজরুল ইসলাম রোডের যে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে ওই নামের কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়ানি।
গণমাধ্যমের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ মন্তব্য সম্পাদকদের : শীর্ষ নিউজ জানায়, জনপ্রিয় অনলাইন দৈনিক শীর্ষ নিউজ ডটকম এবং সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ সম্পাদক একরামুল হককে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়ার ঘটনা গণমাধ্যমের ওপর সরকারের দমন-পীড়নমূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন সংবাদপত্রের সম্পাদকরা। তারা এ ঘটনাকে সংবাদপত্রের ওপর সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন। ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে একরামুল হকের মুক্তির দাবি জানান তারা।
সম্পাদক মো. একরামুল হককে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নেয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বিশিষ্ট সাংবাদিক কলামিস্ট আতাউস সামাদ বলেন, গত কয়েকদিন ধরে শীর্ষ নিউজ ও শীর্ষ কাগজের ওপর সরকার যেভাবে হস্তক্ষেপ করছে তাতে আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম। এ দুটি মিডিয়ার সম্পাদককে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়ার ঘটনায় সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তিনি বলেন, এর আগেও সরকার আমার দেশ সম্পাদকের সঙ্গে একই রকম আচরণ করেছে। তিনি বলেন, আমি মনে করি এই পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়ে আবার ভাবতে হবে। সেইসঙ্গে অবিলম্বে সম্পাদক মো. একরামুল হকের মুক্তি দাবি করেন তিনি। দৈনিক নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দীন শীর্ষ নিউজ ডটকমের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, শীর্ষ নিউজ এবং শীর্ষ কাগজের সম্পাদক মো. একরামুল হককে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়ার ঘটনা চরম দুঃখজনক এবং সংবাদপত্র জগতের ওপর রীতিমত চাপ। তিনি বলেন, এ রকম মিথ্যা চাঁদাবাজি মামলার ফালতু অভিযোগে একজন সম্মানিত সম্পাদককে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নেয়া হলে সংবাদপত্র চলবে না। এ ঘটনায় গোটা সংবাদপত্র জগত্ আহত।
দৈনিক যুগান্তরের নির্বাহী সম্পাদক সাইফুল আলম শীর্ষ নিউজ ডটকমকে বলেন, সম্পাদক মো. একরামুল হককে গ্রেফতারের ঘটনা দুঃখজনক। কারণ প্রতিটি মানুষের সামাজিক মর্যাদা আছে। যে কেউ মামলা করলেই পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে মধ্যরাতে একজন সম্পাদককে গ্রেফতার করবেন, এটা ঠিক নয়। কারণ এর আগে মামলাটির সত্যতা যাচাই করা দরকার ছিল। তিনি বলেন, মামলা করলেই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হলে তো সারাদেশ জেলখানা হয়ে যাবে। তাই আইন প্রয়োগে সংশ্লিষ্টদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
দৈনিক ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত শীর্ষ নিউজ ডটকমের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, সাংবাদিকদের গ্রেফতার কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। যদি কোনো সংবাদ মাধ্যম বা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে তবে প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমেই তা সুরাহা করা উচিত। তিনি বলেন, সম্পাদক মো. একরামুল হককে যে মামলায় আটক করা হয়েছে তার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে প্রচলিত আইনে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে শ্যামল দত্ত বলেন, সাংবাদিকদের হয়রানি বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
দৈনিক দিনকালের সম্পাদক ড. রেজওয়ান সিদ্দিকী বলেন, শীর্ষ নিউজ ডটকম ও শীর্ষ কাগজ সম্পাদক মো. একরামুল হককে গ্রেফতারের ঘটনা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক। এ ধরনের পদক্ষেপ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা ও সংবাদপত্রকে দমন করার অপচেষ্টার শামিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। সেইসঙ্গে সম্পাদক একরামুল হককে অবিলম্বে মুক্তি প্রদানের দাবি জানাচ্ছি। তিনি বলেন, সরকার ভিন্ন মতের রাজনৈতিক দলের ওপর যেমন অসহিষ্ণু আচরণ করে থাকে, তেমনি ভিন্ন মতের গণমাধ্যমের ওপরও একই ধরনের আচরণ করছে। সরকার যখন ব্যর্থ হয় তখনই গণমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়ন চালায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বরিশালে মানববন্ধনে ছাত্রলীগের হামলা : বরিশাল অফিস জানায়, বরিশালে শীর্ষ নিউজ সম্পাদককে গ্রেফতারের প্রতিবাদে সাংবাদিকদের মানববন্ধন কর্মসূচি পণ্ড হয়েছে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায়। হামলায় আহত হন ৫-৬ সংবাদকর্মী। এ সময় ছাত্রলীগের এককর্মীও আহত হয়। শীর্ষ নিউজ ডটকম ও সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজের সম্পাদক একরামুল হককে গ্রেফতারের প্রতিবাদে প্রেস ক্লাবের সামনে এ মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ ও হামলাকারীদের গ্রেফতার এবং শাস্তির দাবিতে তাত্ক্ষণিক নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল করে সাংবাদিকরা। একই সঙ্গে এ ঘটনাকে ন্যক্কারজনক মন্তব্য করে হামলাকারীদের বিচার দাবি করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। অপরদিকে ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন আ’লীগ নেতা ও সিটি মেয়র অ্যাডভোকেট শওকত হোসেন হিরন এবং বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস।
শীর্ষ নিউজ ডটকম সম্পাদককে গ্রেফতারের প্রতিবাদে গতকাল সকালে বরিশাল প্রেস ক্লাবের সামনে সাংবাদিক মাইনুল হাসান সড়কে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। কর্মসূচি শুরুর অনেক আগে থেকেই প্রেস ক্লাব ও আশপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। একই সঙ্গে মহানগর ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী মাইনুল হাসান সড়কে মহড়া দেয়। সোয়া ১০টায় মানববন্ধন শুরু হলে কোতোয়ালি পুলিশ কর্মসূচিতে বাধা দেয়। এ সময় ছাত্রলীগের জোবায়ের, অপু, মিজানুর রহমান মিজান, সুমন, বাহাদুর, তারিক, বাপ্পাসহ ২০-২৫ জন অতর্কিতভাবে কর্মসূচিতে অংশ নেয়া সংবাদকর্মীদের ওপর হামলা চালায়। তারা সাংবাদিকদের কাছ থেকে প্রতিবাদ কর্মসূচির ব্যানার ছিনিয়ে নেয় এবং একাধিক সাংবাদিককে এলোপাতাড়ি মারধর করে। ছাত্রলীগের হামলায় আহত সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন— দৈনিক শাহনামার বার্তা সম্পাদক মামুনুর রশিদ নোমানী, আমার দেশ বরিশাল অফিসের স্টাফ রিপোর্টার নিকুঞ্জবালা পলাশ, শীর্ষ নিউজের বরিশালের স্টাফ রিপোর্টার আহাম্মেদ জালাল, বিডিনিউজ প্রতিনিধি শাহীন হাসান প্রমুখ। মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেয়া সাংবাদিকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল করে সাংবাদিকরা।
চট্টগ্রাম : শীর্ষ নিউজ ডটকম ও সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ সম্পাদক একরামুল হককে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে আয়োজিত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা বলেছেন, বর্তমান সরকার সংবাদপত্র গণমাধ্যমের ওপর দমনপীড়ন চালিয়ে তাদের দুর্নীতি ও অপকর্ম ঢাকা দেয়ার অপচেষ্টা শুরু করেছে। ১৯৭৫ সালের বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে দেশের সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়ে মানুষের বাক-স্বাধীনতা হরণ করেছিল। শেখ মুজিবের সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমান শেখ হাসিনার সরকারও একইভাবে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা, সংবাদপত্র অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের হয়রানি ও নির্যাতনমূলক তত্পরতা চালিয়ে দেশের মানুষের বাক-স্বাধীনতা হরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ উদ্যোগে নগরীর লাভলেইন নূর আহমেদ সড়কের চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিএমইউজে) সামনে বিকাল ৫টায় এ মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
এতে সংহতি প্রকাশ করে অংশ নেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন, দৈনিক আমার দেশ পাঠক মেলার, স্বাধীনতা ফোরাম, চ্যানেল ওয়ান দর্শক ফোরামসহ পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
সমাবেশে বক্তৃতা করেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ নেওয়াজ, দৈনিক আমার দেশ ব্যুরো প্রধান জাহিদুল করিম কচি, মুস্তফা নঈম, মনোয়ারা বেগম মনি, জেলী চৌধুরী, হোসেন দিপ্তি, এমএ কাদের, মো. ইদ্রিস আলী, পাঠক মেলার সাধারণ সম্পাদক হেলাল এম রহমান।
পাবনা : শীর্ষ নিউজ ডটকম এবং সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ সম্পাদককে পুলিশ গ্রেফতার করায় গতকাল পাবনা প্রেস ক্লাবের কর্মকর্তা ও কর্মরত সাংবাদিকরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ ও নিন্দা করেছেন।
বিবৃতিদাতারা হলেন, পাবনা প্রেস ক্লাবের সভাপতি রুমী খন্দকার, সাধারণ সম্পাদক উত্পল মির্জা, আহমেদ উল হক রানা, শফি ইসলাম, কৃষ্ণ ভৌমিক, ছিফাত রহমান সনম, এবিএম ফজলুর রহমান, আবদুল মজিদ দুদু, আমার দেশ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার জহুরুল ইসলাম, এএসএম আবদুল্লাহ, তপু আহমেদ, আঁখিনুর ইসলাম রেমন, জিকে সাদী, শাহীন রহমান, কাজী মোর্শেদ বাবলা, আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী প্রমুখ।
বিভিন্ন সংগঠনের নিন্দা : সাংবাদিক একরামুল হককে রিমান্ডে নেয়ার ঘটনায় মর্মাহত হয়েছেন ক্ষমতাসীন মহাজোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। গতকাল বিকালে শীর্ষ নিউজ ডটকম প্রতিবেদককে ফোন করে এরশাদের রাজনৈতিক ও প্রেসসচিব সুনীল শুভরায় এ তথ্য জানান। তিনি আরও জানান, অভিযোগ তদন্ত না করে একজন সম্পাদককে এভাবে গ্রেফতারের নিন্দা করেছেন এরশাদ। সেই সঙ্গে একরামুল হকের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়েছেন তিনি।
শীর্ষ নিউজ সম্পাদক একরামুল হককে গ্রেফতারের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি মোস্তাক হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দীন। গতকাল ডিআরইউ’র দফতর সম্পাদক জসীমউদ্দিন খান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে তারা এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। নেতারা বলেন, সাংবাদিকসহ কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন, কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে মিথ্যা মামলায় জড়ানো, সাংবাদিক নির্যাতন কারও কাম্য নয়। সেই সঙ্গে একজন পেশাদার সাংবাদিকের সঙ্গে সংযত আচরণ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পারভেজ খান ও সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু সাংবাদিক একরামুল হককে গ্রেফতারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ক্র্যাব নেতারা একজন পেশাদার সাংবাদিকের সঙ্গে সংযত আচরণ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।
এদিকে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশ মফস্বল মানবাধিকার সাংবাদিক ফোরাম (বামমাসাফো) অবিলম্বে সম্পাদক একরামুল হককে মুক্তি দিতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে। সোমবার বামমাসাফো’র উপদেষ্টা অধ্যাপক মো. শামসুল আলম ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাখাওয়াত্ হোসেন ইবনে মইন চৌধুরী এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে দেশকে সন্ত্রাস দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়নের রাষ্ট্রে পরিণত করতে সাংবাদিক ও ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
সাজানো মিথ্যা মামলায় একরামুল হককে পুলিশ রোববার ভোর রাতে মগবাজারের বাসা থেকে গ্রেফতার করে। মামলার
বাদীর ঠিকানারও অস্তিত্ব নেই। তার বিরুদ্ধে যে বানোয়াট চাঁদাবাজি মামলা দেয়া হয়েছে তা কতখানি সত্য এ বিষয়টিও তদন্ত করেনি পুলিশ। মিথ্যা মামলা দেয়ার অভিযোগে বাদীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো একরামুল হককে জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নেয়া হয়। গতকাল রিমান্ডের প্রথম দিন অতিবাহিত হয়েছে। ঘনিষ্ঠজনদের মতে, কলাবাগান থানার মামলায় একরামুলকে রমনা থানায় রাখা রহস্যজনক। রমনা থানা মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয় সংলগ্ন। জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে গোয়েন্দা পুলিশের মুখোমুখি করা হতে পারে বলে স্বজনরা উদ্বিগ্ন। ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, মিথ্যা মামলায় তাকে রিমান্ডে নিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
একরামুল হকের এক আত্মীয় জানান, রোববার বিকালে একরামুলকে রমনা থানায় নেয়ার পর থেকে পুলিশ ব্যাপক কড়াকড়ি করে। থানার সামনে থেকে সন্দেহজনক লোকজনক সরিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। তিনি হাজতখানায় কী অবস্থায় রয়েছেন তা আমরা জানতে পারিনি। তবে যতটুকু জেনেছি ওই রাতে দু’জন হাজতির সঙ্গে একরামুলকে রাখা হয়েছে। তাকে বাইরে থেকে খাবার সরবরাহ করতে দেয়া হয়নি। তবে অনেক অনুরোধের পর গতকাল ভোরে একরামুলের স্ত্রী মাহবুবা হক ও মেয়ে সুমাইয়াকে এক মিনিটের জন্য সময় দেয় পুলিশ। মাহবুবা হক স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করলেও কথা বলতে পারেননি। পুলিশ নির্দিষ্ট সময় পর মেয়েকে থানা থেকে বের করে দেয়।
মাহবুবা হক বলেন, তার স্বামীকে অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। সরকারের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের খবর প্রকাশ করায় একরামুল হক একটি মহলের টার্গেটে পরিণত হন। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের আমলে গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার দুর্নীতি, যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতি, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি, প্রধানমন্ত্রীর এপিএসের বিভিন্ন অপকর্ম এবং পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রীর দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করায় শীর্ষ নিউজ ও শীর্ষ কাগজ সরকারের রোষানলে পড়ে। এর আগেও তার ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মাহবুবা হক।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কলাবাগান থানার সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) আতিকুর রহমান জানান, সাংবাদিক একরামুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার কাছ থেকে কী তথ্য পাওয়া গেছে জানতে চাইলে এসআই বলেন, কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, যা এখন না বললেই ভালো। তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ওনার ব্যাপারে আর কিছু আমাকে জিজ্ঞাসা না করলেই ভালো। পুলিশের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, ‘একরামুলের কাছ থেকে কী তথ্য পাওয়া যেতে পারে তা আপনিও বুঝেন আমিও জানি। তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য না করে বলেন, এ ধরনের গ্রেফতার ও রিমান্ডে পুলিশ বিব্রত হয়’। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে অনেক সময় পুলিশ অনিয়ম করতে বাধ্য হয়। ওনাকে গ্রেফতার করে থানা হাজতে রেখে পুলিশকে অতিরিক্ত ঝামেলায় ফেলা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, রমনা থানা হেফাজতে গতকাল পর্যন্ত উনি ভালো ছিলেন।’
প্রসঙ্গত, গিয়াসউদ্দিন তালুকদার নামের এক ব্যবসায়ী একরামুল হকের বিরুদ্ধে ঢাকা সিএমএম আদালতে দায়ের করা একটি চাঁদাবাজির মামলায় পুলিশের একটি দল বড় মগবাজারের বাসা থেকে একরামুল হককে গ্রেফতার করে। তবে আদালত মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে তদন্ত করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিলেও তাকে তড়িঘড়ি গ্রেফতার করে পুলিশ।
অনুসন্ধান করে মামলার বাদী গিয়াসউদ্দিন তালুকদারের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বলাকা ইন্টারন্যাশনালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাযনি। মামলার এজাহারে বলাকার ঢাকা কার্যালয় হিসেবে যে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে সরেজমিন গিয়ে ওই নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরও কোনো হদিস মেলেনি। অন্যদিকে চট্টগ্রামে খোঁজ নিয়েও জানা গেছে, বলাকা ইন্টারন্যাশনালের প্রধান কার্যালয় হিসেবে চট্টগ্রাম ফিরিঙ্গিবাজারের কাজী নজরুল ইসলাম রোডের যে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে ওই নামের কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়ানি।
গণমাধ্যমের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ মন্তব্য সম্পাদকদের : শীর্ষ নিউজ জানায়, জনপ্রিয় অনলাইন দৈনিক শীর্ষ নিউজ ডটকম এবং সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ সম্পাদক একরামুল হককে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়ার ঘটনা গণমাধ্যমের ওপর সরকারের দমন-পীড়নমূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন সংবাদপত্রের সম্পাদকরা। তারা এ ঘটনাকে সংবাদপত্রের ওপর সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন। ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে একরামুল হকের মুক্তির দাবি জানান তারা।
সম্পাদক মো. একরামুল হককে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নেয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বিশিষ্ট সাংবাদিক কলামিস্ট আতাউস সামাদ বলেন, গত কয়েকদিন ধরে শীর্ষ নিউজ ও শীর্ষ কাগজের ওপর সরকার যেভাবে হস্তক্ষেপ করছে তাতে আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম। এ দুটি মিডিয়ার সম্পাদককে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়ার ঘটনায় সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তিনি বলেন, এর আগেও সরকার আমার দেশ সম্পাদকের সঙ্গে একই রকম আচরণ করেছে। তিনি বলেন, আমি মনে করি এই পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়ে আবার ভাবতে হবে। সেইসঙ্গে অবিলম্বে সম্পাদক মো. একরামুল হকের মুক্তি দাবি করেন তিনি। দৈনিক নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দীন শীর্ষ নিউজ ডটকমের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, শীর্ষ নিউজ এবং শীর্ষ কাগজের সম্পাদক মো. একরামুল হককে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়ার ঘটনা চরম দুঃখজনক এবং সংবাদপত্র জগতের ওপর রীতিমত চাপ। তিনি বলেন, এ রকম মিথ্যা চাঁদাবাজি মামলার ফালতু অভিযোগে একজন সম্মানিত সম্পাদককে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নেয়া হলে সংবাদপত্র চলবে না। এ ঘটনায় গোটা সংবাদপত্র জগত্ আহত।
দৈনিক যুগান্তরের নির্বাহী সম্পাদক সাইফুল আলম শীর্ষ নিউজ ডটকমকে বলেন, সম্পাদক মো. একরামুল হককে গ্রেফতারের ঘটনা দুঃখজনক। কারণ প্রতিটি মানুষের সামাজিক মর্যাদা আছে। যে কেউ মামলা করলেই পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে মধ্যরাতে একজন সম্পাদককে গ্রেফতার করবেন, এটা ঠিক নয়। কারণ এর আগে মামলাটির সত্যতা যাচাই করা দরকার ছিল। তিনি বলেন, মামলা করলেই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হলে তো সারাদেশ জেলখানা হয়ে যাবে। তাই আইন প্রয়োগে সংশ্লিষ্টদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
দৈনিক ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত শীর্ষ নিউজ ডটকমের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, সাংবাদিকদের গ্রেফতার কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। যদি কোনো সংবাদ মাধ্যম বা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে তবে প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমেই তা সুরাহা করা উচিত। তিনি বলেন, সম্পাদক মো. একরামুল হককে যে মামলায় আটক করা হয়েছে তার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে প্রচলিত আইনে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে শ্যামল দত্ত বলেন, সাংবাদিকদের হয়রানি বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
দৈনিক দিনকালের সম্পাদক ড. রেজওয়ান সিদ্দিকী বলেন, শীর্ষ নিউজ ডটকম ও শীর্ষ কাগজ সম্পাদক মো. একরামুল হককে গ্রেফতারের ঘটনা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক। এ ধরনের পদক্ষেপ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা ও সংবাদপত্রকে দমন করার অপচেষ্টার শামিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। সেইসঙ্গে সম্পাদক একরামুল হককে অবিলম্বে মুক্তি প্রদানের দাবি জানাচ্ছি। তিনি বলেন, সরকার ভিন্ন মতের রাজনৈতিক দলের ওপর যেমন অসহিষ্ণু আচরণ করে থাকে, তেমনি ভিন্ন মতের গণমাধ্যমের ওপরও একই ধরনের আচরণ করছে। সরকার যখন ব্যর্থ হয় তখনই গণমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়ন চালায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বরিশালে মানববন্ধনে ছাত্রলীগের হামলা : বরিশাল অফিস জানায়, বরিশালে শীর্ষ নিউজ সম্পাদককে গ্রেফতারের প্রতিবাদে সাংবাদিকদের মানববন্ধন কর্মসূচি পণ্ড হয়েছে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায়। হামলায় আহত হন ৫-৬ সংবাদকর্মী। এ সময় ছাত্রলীগের এককর্মীও আহত হয়। শীর্ষ নিউজ ডটকম ও সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজের সম্পাদক একরামুল হককে গ্রেফতারের প্রতিবাদে প্রেস ক্লাবের সামনে এ মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ ও হামলাকারীদের গ্রেফতার এবং শাস্তির দাবিতে তাত্ক্ষণিক নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল করে সাংবাদিকরা। একই সঙ্গে এ ঘটনাকে ন্যক্কারজনক মন্তব্য করে হামলাকারীদের বিচার দাবি করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। অপরদিকে ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন আ’লীগ নেতা ও সিটি মেয়র অ্যাডভোকেট শওকত হোসেন হিরন এবং বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস।
শীর্ষ নিউজ ডটকম সম্পাদককে গ্রেফতারের প্রতিবাদে গতকাল সকালে বরিশাল প্রেস ক্লাবের সামনে সাংবাদিক মাইনুল হাসান সড়কে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। কর্মসূচি শুরুর অনেক আগে থেকেই প্রেস ক্লাব ও আশপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। একই সঙ্গে মহানগর ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী মাইনুল হাসান সড়কে মহড়া দেয়। সোয়া ১০টায় মানববন্ধন শুরু হলে কোতোয়ালি পুলিশ কর্মসূচিতে বাধা দেয়। এ সময় ছাত্রলীগের জোবায়ের, অপু, মিজানুর রহমান মিজান, সুমন, বাহাদুর, তারিক, বাপ্পাসহ ২০-২৫ জন অতর্কিতভাবে কর্মসূচিতে অংশ নেয়া সংবাদকর্মীদের ওপর হামলা চালায়। তারা সাংবাদিকদের কাছ থেকে প্রতিবাদ কর্মসূচির ব্যানার ছিনিয়ে নেয় এবং একাধিক সাংবাদিককে এলোপাতাড়ি মারধর করে। ছাত্রলীগের হামলায় আহত সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন— দৈনিক শাহনামার বার্তা সম্পাদক মামুনুর রশিদ নোমানী, আমার দেশ বরিশাল অফিসের স্টাফ রিপোর্টার নিকুঞ্জবালা পলাশ, শীর্ষ নিউজের বরিশালের স্টাফ রিপোর্টার আহাম্মেদ জালাল, বিডিনিউজ প্রতিনিধি শাহীন হাসান প্রমুখ। মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেয়া সাংবাদিকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল করে সাংবাদিকরা।
চট্টগ্রাম : শীর্ষ নিউজ ডটকম ও সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ সম্পাদক একরামুল হককে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে আয়োজিত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা বলেছেন, বর্তমান সরকার সংবাদপত্র গণমাধ্যমের ওপর দমনপীড়ন চালিয়ে তাদের দুর্নীতি ও অপকর্ম ঢাকা দেয়ার অপচেষ্টা শুরু করেছে। ১৯৭৫ সালের বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে দেশের সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়ে মানুষের বাক-স্বাধীনতা হরণ করেছিল। শেখ মুজিবের সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমান শেখ হাসিনার সরকারও একইভাবে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা, সংবাদপত্র অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের হয়রানি ও নির্যাতনমূলক তত্পরতা চালিয়ে দেশের মানুষের বাক-স্বাধীনতা হরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ উদ্যোগে নগরীর লাভলেইন নূর আহমেদ সড়কের চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিএমইউজে) সামনে বিকাল ৫টায় এ মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
এতে সংহতি প্রকাশ করে অংশ নেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন, দৈনিক আমার দেশ পাঠক মেলার, স্বাধীনতা ফোরাম, চ্যানেল ওয়ান দর্শক ফোরামসহ পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
সমাবেশে বক্তৃতা করেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ নেওয়াজ, দৈনিক আমার দেশ ব্যুরো প্রধান জাহিদুল করিম কচি, মুস্তফা নঈম, মনোয়ারা বেগম মনি, জেলী চৌধুরী, হোসেন দিপ্তি, এমএ কাদের, মো. ইদ্রিস আলী, পাঠক মেলার সাধারণ সম্পাদক হেলাল এম রহমান।
পাবনা : শীর্ষ নিউজ ডটকম এবং সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ সম্পাদককে পুলিশ গ্রেফতার করায় গতকাল পাবনা প্রেস ক্লাবের কর্মকর্তা ও কর্মরত সাংবাদিকরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ ও নিন্দা করেছেন।
বিবৃতিদাতারা হলেন, পাবনা প্রেস ক্লাবের সভাপতি রুমী খন্দকার, সাধারণ সম্পাদক উত্পল মির্জা, আহমেদ উল হক রানা, শফি ইসলাম, কৃষ্ণ ভৌমিক, ছিফাত রহমান সনম, এবিএম ফজলুর রহমান, আবদুল মজিদ দুদু, আমার দেশ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার জহুরুল ইসলাম, এএসএম আবদুল্লাহ, তপু আহমেদ, আঁখিনুর ইসলাম রেমন, জিকে সাদী, শাহীন রহমান, কাজী মোর্শেদ বাবলা, আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী প্রমুখ।
বিভিন্ন সংগঠনের নিন্দা : সাংবাদিক একরামুল হককে রিমান্ডে নেয়ার ঘটনায় মর্মাহত হয়েছেন ক্ষমতাসীন মহাজোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। গতকাল বিকালে শীর্ষ নিউজ ডটকম প্রতিবেদককে ফোন করে এরশাদের রাজনৈতিক ও প্রেসসচিব সুনীল শুভরায় এ তথ্য জানান। তিনি আরও জানান, অভিযোগ তদন্ত না করে একজন সম্পাদককে এভাবে গ্রেফতারের নিন্দা করেছেন এরশাদ। সেই সঙ্গে একরামুল হকের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়েছেন তিনি।
শীর্ষ নিউজ সম্পাদক একরামুল হককে গ্রেফতারের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি মোস্তাক হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দীন। গতকাল ডিআরইউ’র দফতর সম্পাদক জসীমউদ্দিন খান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে তারা এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। নেতারা বলেন, সাংবাদিকসহ কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন, কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে মিথ্যা মামলায় জড়ানো, সাংবাদিক নির্যাতন কারও কাম্য নয়। সেই সঙ্গে একজন পেশাদার সাংবাদিকের সঙ্গে সংযত আচরণ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পারভেজ খান ও সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু সাংবাদিক একরামুল হককে গ্রেফতারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ক্র্যাব নেতারা একজন পেশাদার সাংবাদিকের সঙ্গে সংযত আচরণ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।
এদিকে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশ মফস্বল মানবাধিকার সাংবাদিক ফোরাম (বামমাসাফো) অবিলম্বে সম্পাদক একরামুল হককে মুক্তি দিতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে। সোমবার বামমাসাফো’র উপদেষ্টা অধ্যাপক মো. শামসুল আলম ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাখাওয়াত্ হোসেন ইবনে মইন চৌধুরী এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে দেশকে সন্ত্রাস দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়নের রাষ্ট্রে পরিণত করতে সাংবাদিক ও ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।