আমি সাধারন একজন মানুষ। কিন্তু মনে করি, ইভ টিজিংয়ের প্রেক্ষাপট ও সমস্যা বোঝার জন্য সমাজবিজ্ঞানী বা মনস্তত্ববিদ হবার প্রয়োজন নেই।বরং দরকার দুটো কর্দহীন চোখ আর মানুষের প্রতি একটু ভালবাসা। আমাদের অনেকেরই যা আছে। তাই আমি উইকিপিডিয়া ঘেঁটে আজ ইভ টিজিং-য়ের ইতিহাস তুলে ধরবো না।বলব না মুখস্ত হয়ে যাওয়া অন্যান্য সমাধানসমুহ। বলব আমার ব্যক্তিগত কিছু উপলব্ধির কথা যার প্রমান ও সত্যতা আমি প্রতিনিয়ত পাই,অন্যদের মতই।
আমাদের দেশে ইভ টিজিং শব্দেরও প্রয়োগ যথেষ্ট সাম্প্রতিক, যদিও এর ভয়াবহতার সাথে আমরা পরিচিত অনেক আগের থেকেই।এর বিরুদ্ধে ছোটো-খাটো মানসিক ও সামাজিক জাগরণের জোয়ার আরো নতুন।বলে রাখা ভাল এটা সম্ভব হচ্ছে মিডিয়ার প্রচার-প্রসারে । শিক্ষার হার বৃদ্ধিও অন্যতম আশ্রয়। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য মিডিয়ার মুনাফালোভী মানসিকতা ও টাকায় কেনা শিক্ষার নিম্ন মানও পরোক্ষভাবে ইভ টিজিংকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
আমাদের সমাজে আবহমানকাল থেকেই নারী ব্যবসার অন্যতম মাধ্যম। বর্তমানে নারী পন্য, নোংরা আধুনিকতার দূত, দেহ-সর্বস্ব বিনোদনের ডামি... মানুষতো নয়। আর নারীর এইসব মাদকতাময় নির্জীব বিজ্ঞাপন তেজস্ক্রিয় পদার্থের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র দুনিয়ায়, স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল এর হাত পিঠে চড়ে, ইন্টারনেটের হাত গলে, প্রিন্টিং মিডিয়ার পৃষ্ঠার ভাঁজে ভাঁজে। সংক্রমিত হচ্ছে অজস্র চারা গাছ। বয়স হবার আগেই মারা যাচ্ছে ঘুমিয়ে থাকা শিশুর পিতারা, না বুঝে সকালের জানালা খোলার মতই সারল্যে।
এদেশের সংস্কৃতি যারা বুকে ধারন করে এগিয়ে যাবে সেইসব কিশোর-কিশোরী-তরুন-তরুনীদের মাথা খাচ্ছে ক্যাটরিনার "শিলা কি জাওয়ানী''। ঐশ্বরিয়ার,- 'আমার মত কাটাতে চাও?' আহবানে সাড়া দিয়ে এদেশের সবুজ মেয়েরা হতে চাচ্ছে হিন্দী ফিল্মের ইচ্ছে-খুশি নায়িকা। বাল্যের স্বর্ণময় সময় কাটাচ্ছে তারা হিন্দি সিরিয়ালের পরকিয়ায়। আমাদের ছেলেরা হতে চাচ্ছে এমরান হাশমির কিছু চরিত্রের মত নারী শিকারী। তরুনদের মোবাইলে নেচে ফিরছে মাদকতাময় মেয়েদের দেহ। ক্রিকেট বাদে এখনকার সময়ের আড্ডার অন্যতম বিষয় সাইফ-কারিনা;শহীদ-প্রিয়াংকার মত নায়ক-নায়িকাদের অস্থির দিক-পরিবর্তন ও নোঙ্গর-নোংরামী। এসব খবরের মাঝে একজন কিশোর-তরুনের কিইবা শেখার আছে? তবুও ঢালাও ভাবে ছাপা হচ্ছে 'বদলে যাও,বদলে দাও' শীর্ষক মানবিক আন্দোলনের জন্ম দেয়া শীর্ষ দৈনিক "প্রথম আলো"র মত পত্রিকাতেও। এটাকি পত্রিকাটির ব্যবসায়িক স্বার্থকেই বড় করে দেখায় না? পত্রিকাটি আমাকে প্রতিদিন অনেক আনন্দের মাঝে এই একটি কষ্ট দেয়, ভেবে অবাক হই- সচেতনভাবে? নাকি সবই ফাঁকি! এদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতেও এসব সচেতনভাবে অনেক ভাল অনুষ্ঠানের পাশাপাশি পরিবেশন করা হচ্ছে।গেমশোর নামে যাত্রা আরম্ভ করেছে উদ্ভট অনুষ্ঠান, অদুর ভবিষ্যতে যেসব অনুষ্ঠানে দেখানো হবে AXN এর মতো চ্যানেলগুলোতে দেখানো পোঁকামাকড় খাওয়ার পাগলামি।
ভারতে বাংলাদেশের যথেষ্ট নির্দোষ টিভি চ্যানেলগুলো এখনও পায় নি প্রচারের ভিসা, আর আমারা কিনা নিজ দেশের কৃষ্টি মেরে ওদের নোংরা গিলছি? কারন আমাদের খাবারের মেনুতে ডাল-ভাত-সবজির বদলে তারই ব্যবস্থা করে রেখেছে ব্যবসা-বিলাসী সরকার। আমাদের দেশে আকাশ সংস্কৃতি রোধে নেই কোনো সরকারি মনিটরিং। শিক্ষা ও সংস্কৃতি খাতে সরকারের বাজেটও আমার মতে ন্যাক্কারজনক।
তরুনদের চোখে নগ্ন রঙ্গীন চশমা পড়ানোর জন্য সে নিজে কতটা দায়ী? মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের যে কথা বলা হচ্ছে তার সমাধানে শুধু মাত্র কিছু আইন প্রনয়ণ ও শাস্তির বিধানই যথেষ্ট নয়। কারন ইভ টিজিংয়ের ধরন নিয়মিত পরিবর্তিত হচ্ছে, হবে। সাথে দরকার অবক্ষয়ের পথগুলো বন্ধ করা। ব্যবসার খ্যাতিরে ইভ টিজিংয়ের খামার ভিনদেশি সংস্কৃতির কাল দিকটির আগ্রাসন মেনে নেয়া কারও কাম্য নয়।
আজ আমাদের বেশিকরে দরকার ব্যক্তিগত-সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ছাঁকনীর। যে ছাকনির ব্যবহারে মন ও মনন হবে পরিশ্রুত, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গিতে পারস্পরিক সহবস্থান হবে আনন্দময়, অবসরে সুকুমারবৃত্তির চর্চায় সৃজনশীলতা পাবে আলোকদীপ্ত দিগন্তের সন্ধান।
নিজ দেশের সংস্কৃতির চাষে হৃদয়ে জাগবে দেশপ্রেম-জাতীয়তাবোধ। তাহলেই ইভ টিজিংয়ের মত সামাজিক ব্যাধি হতে দেশ ও সমাজ পাবে মুক্তি।